ধর্ম, যা মন কে ধারণ করে। ধর্ম, যা আশ্রয় দেয়। ধর্ম, যা সহিষ্ণুতা ও সহনশীলতার শিক্ষা দেয়। ধর্ম, যা পরস্পরকে শ্রদ্ধা করতে শেখায়। ধর্ম, যা উদারতাকে সঙ্গী করে নিতে বলে। আমার প্রিয় পাঠকেরা, ধর্ম বলতে আমি ঠিক এই বিষয়গুলিই বুঝি। আর তাই আমার মনেহয়,এই সমস্ত বিষয় একসাথে আমি যার মধ্যে দেখতে পাই সে হলো এই পৃথিবী। এই পৃথিবী যে ধর্মে আমাদের দীক্ষিত করতে চায় তার মহান নীরবতার মাধ্যমে, তা হল পৃথিবীধর্ম। এই পৃথিবীর বুকেই আমরা নানা সময়ে নানা ধর্মের অবতারণা হতে দেখেছি। নানা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে তাদের অনুসৃত ধর্ম ও সেই ধর্মের অনুশাসন অতি পবিত্র ও অবশ্য পালনীয়। এই অধ্যায়ে অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করবো। সেটি হল, পৃথিবীর সবথেকে আলোচিত সাতটি পবিত্র ধর্মীয় স্থানের কথা।
একেবারে প্রথমেই যে পবিত্র স্থানের কথা এই প্রসঙ্গে আসছে, তা হল জেরুজালেম শহর। এই শহরটি পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এক শহর। এই অতি প্রাচীন শহরটির সঙ্গে এক আশ্চর্য মেলবন্ধন ও অত্যন্ত নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে পৃথিবীর তিনটি অন্যতম বৃহৎ ধর্মের সঙ্গে! সেই তিনটি ধর্ম হল- জুডাইসম, খ্রীস্টান ধর্ম ও ইসলাম ধর্ম। ওল্ড টেস্টামেন্টের ভাষ্য অনুযায়ী সম্রাট ডেভিড তাঁর রাজ্য ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে জেরুজালেম শহর প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর ছেলে সলোমন এখানে প্রথম মন্দির বানিয়ে ছিলেন। নিউ টেস্টামেন্টে উল্লেখ আছে যিশুখ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল এই জেরুজালেম শহরেই।
আর কোরানের ভাষ্য অনুযায়ী, মহম্মদ মক্কা থেকে এক রাতের মধ্যে অতি আশ্চর্য রহস্যময় এক সফরে জেরুজালেমে পৌঁছেছিলেন এবং এখান থেকেই তিনি স্বর্গারোহণ করেন আল্লাহ এর সাথে কথা বলার জন্য। যদিও ইজরায়েল আর প্যালেস্তাইনের মধ্যে এক অতি সুদীর্ঘ স্থায়ী যুদ্ধের এক রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্ন বহন করে চলেছে এই শহর কারণ দুই দেশই দাবি করে যে জেরুজালেম তাদেরই রাজধানী, তবু ভিন্ন ভিন্ন কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে জেরুজালেম শহর তাদের মনের আবেগের, ভালোবাসার ও পবিত্রতার প্রতীক।
সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ হিন্দু তাদের সারা জীবনে অন্ততঃ একবার যেখানে যেতে চায় তা হল কাশী বিশ্বনাথ মন্দির। ভারতবর্ষের উত্তর প্রদেশের বেনারসে বা বারাণসীতে গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত এই মন্দির। শিবের উদ্দেশ্যে এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত ও উৎসর্গীকৃত হয়। এখানে জ্যোতির্লিঙ্গ রূপ পরিগ্রহ করেছেন শিব। কথিত আছে, ভক্তদের উদ্দেশ্যে একটি অতি উজ্জ্বল অগ্নিময় আলোকস্তম্ভের রূপে এখানে আবির্ভূত হন তিনি। এই কাশী বিশ্বনাথ মন্দির নিয়ে প্রচুর মিথ্ ছড়িয়ে আছে যা ভক্তদের কাছে অত্যন্ত আবেগের ও শ্রদ্ধার।
বিশ্বের প্রাচীন ও সমাদৃত একটি ধর্মস্থান হল লরিডেস। দক্ষিণ-পশ্চিম ফ্রান্সের পিরেনিস পর্বতের পাদদেশে এই শহরটি অবস্থিত। ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই তীর্থস্থান অতি পবিত্র। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করেন যে আঠেরোশো আটান্ন সালে মা মেরি আঠেরো বার দেখা দেন স্থানীয় একটি চোদ্দ বছরের মেয়েকে, যার নাম ছিল বার্নাডেট সোত্তবিরাস। তারপর থেকেই এটি অতি পবিত্র ধর্মস্থান হিসেবে মান্যতা পায় এবং আঠেরোশো ষাট সাল থেকে দুশো লক্ষেরও বেশি মানুষ এই তীর্থস্থানে ভ্রমণ করে গেছেন এবং তাদের মধ্যে অনেকেরই ধারণা সেখানকার গুহা নিঃসৃত ঝর্ণার জলে রোগমুক্তি ঘটে।
এই ভারতবর্ষেই আরেকটি অতি পবিত্র স্থান আছে যেখানে মহাবোধি মন্দির আছে। বিহারের বুদ্ধগয়ায় অবস্থিত এই মহাবোধি মন্দির। গৌতম যখন মহাজ্ঞানের আলোকপ্রাপ্ত হয়ে মহাজ্ঞানী রূপে বুদ্ধদেব নামে আবির্ভূত হলেন সেই ক্ষণকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্যেই নির্মাণ হয় এই মন্দিরের। বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধদের কাছে এটি পরম তীর্থস্থান।
মক্কা। নবী মুহাম্মদের জন্মস্থান এবং তিনি ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক। তাই সারা বিশ্বের অসংখ্য ইসলাম ধর্মাবলম্বীর কাছে এই মক্কা পরম পবিত্র স্থান। সমুদ্র উপকূল থেকে পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার ভেতরে সিরাট পর্বতের গায়ে হেজাজ বা হিজাজ নামক পবিত্র ধর্মীয় স্থানের অন্তর্গত এই মক্কা একটি মরুদ্যান। ইসলাম ধর্মের পবিত্রতম মসজিদ, আল- মসজিদ- আল- হারাম এর একেবারে মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত কাবা সৌধ। ইসলাম ধর্মের পবিত্রতম স্থান এই কাবা। প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলিমের আন্তরিক ইচ্ছা থাকে প্রার্থনার সময় কাবার দিকে মুখ করে প্রার্থনা করার। অ-মুসলিমদের এই স্থানে প্রবেশ নিষেধ।
উলুরু এন্ড ক্যাটা টুজটা ন্যাশনাল পার্ক, অস্ট্রেলিয়া। সেন্ট্রাল অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমিতে লক্ষ লক্ষ বছর আগের একাধিক লাল রঙের পাহাড় আছে। অস্ট্রেলিয়ার আদিমতম অধিবাসীদের অন্যতম ইয়াঙ্কুন টাজটারা আর পিটজাটাজটারা, এই দুই শ্রেণীর আদিবাসীদের যারা দশ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে এই স্থানে বাস করছে, তাদের ধারণা একসময় এই পৃথিবীতে একদল প্রাণী বাস করত, তারাই এই অঞ্চল তৈরি করেছিল এবং তারা কিছু ধর্মীয় অনুশাসন সৃষ্টি করেছিল যা ঐ পবিত্রভূমি, ঐ অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ ও জীবজন্তুর মধ্যে এক আত্মিক সেতু হয়ে বিরাজ করবে।
মিশরের মাউন্ট সিনাই অথবা মাউন্ট হোরেব। ইহুদি, খ্রীষ্টান এবং ইসলাম ধর্মে অতীব গুরুত্বপূর্ণ মোজেস এখানেই ‘ঈশ্বরের দশটি আদেশ’ প্রাপ্ত হন এবং হাজার হাজার বছর ধরে এই বিশ্বাসেই অসংখ্য মানুষ, যাদের মধ্যে সাধু-সন্ত এবং নিছক কৌতুহলী পর্যটকও আছেন তারা এই স্থানে এসেছেন, এই স্থানের মাহাত্ম্য ও পবিত্রতা উপলব্ধি করার জন্য।
এইবারে আমার কিছু কথা। আসলে প্রত্যেক অধ্যায়ের শেষে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার পর মনে হয় আমার তো নিজস্ব কিছু কথা, কিছু ভাবনা আছে; সেগুলো আপনাদের সাথে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করে। মনে হয় আপনাদের এই কথাগুলো শোনাই। নিজের অনুভূতি ভাগ করে নিতে চাই আপনাদের সাথে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, অনুভূতি আলাদা আলাদাভাবে, ভাগে ভাগে পৌঁছায় বটে মানুষের কাছে কিন্তু অনুভূতি কখনো ভাগ হয় না! ছড়িয়ে যায় এক মানুষ থেকে অন্য মানুষের অন্তরে ঠিক তেমনি করে, যেমন পুকুরের এপার থেকে ছোঁড়া ঢিলের ছোঁয়ায় কাঁপন ধরে পুকুরের বুকে আর সে কাঁপন সারা পুকুরের বুক জুড়ে আলোড়ন তোলে, অথচ অমোঘ।
পৃথিবীর অত্যন্ত পরিচিত ও পবিত্র স্থান বলে আলোচিত কিছু স্থান নিয়ে আলোচনা করলাম, হয়তো আরো অনেক স্থানই আলোচনার বাইরে রয়ে গেল! কিন্তু এইসব স্থানের কথা উল্লেখ করতে গিয়েই আমার মনে হয়, আলাদা আলাদা করে এই সমস্ত স্থানকে অত্যন্ত পবিত্র বলা হয়েছে বটে, কিন্তু আমার বারবার মনে হয়, শুধু পবিত্র নয়, পবিত্রতম বলে যদি কিছু থাকে তাহলে এই পরিচয়ের এক ও অদ্বিতীয় দাবিদার এই পৃথিবী! আর কেউ নয়, কিচ্ছু নয়। তাহলে এই পৃথিবীর সব স্থানই তো পবিত্রতম। ধর্মের ভিত্তিতে, স্থাপত্যের ভিত্তিতে বা অন্যান্য কিছুর ভিত্তিতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে শ্রেষ্ঠত্বের বা পবিত্রতার দাবি তুলে এসেছে মানুষই, পৃথিবী নয়! ধর্মের ভিত্তিতে, নানা আচার-অনুষ্ঠান, সংস্কারের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে নিজেদের, করে রেখেছে কোন ক্ষুদ্র অঞ্চলবাসী কিন্তু পৃথিবীবাসী হয়ে ওঠেনি কখনোই। ধর্ম কথার অর্থ- যা ধারণ করে। অর্থাৎ সভ্যতা, সংস্কৃতি, উদারতা ইত্যাদি যা লালন করে সযত্নে ! তাই যদি হয়, এই পৃথিবীর থেকে বড় ধার্মিক কে? গর্ভধারিনী মা বা জন্মদাতা পিতা, এঁরাও প্রত্যাশা রাখেন সন্তানের কাছে! প্রথমত, প্রত্যেক বাবা-মাই চান, তাদের সন্তান হোক সুসন্তান। আর সেই সুসন্তান যেন ভবিষ্যতে বাবা-মায়ের দেখাশোনার দায়িত্ব ঠিকভাবে করে। এই প্রত্যাশায় আঘাত এলেই স্বপ্নভঙ্গ হয়, তা থেকেই ঘটে অনেক পারিবারিক বিপর্যয়। কিন্তু পৃথিবী মায়ের আমাদের কাছে কোনো প্রত্যাশা নেই, তাই প্রত্যাশা ভঙ্গের বেদনায়ও তাকে স্পর্শ করে না! এই পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ, সবাই তাঁর সন্তানতুল্য নয়, সন্তান! তাই কারোর প্রতি তাঁর কোনো বিশেষ পক্ষপাতিত্ব নেই! তাই গাছের ফল অথবা ঝরনার জল, বৃক্ষের ছায়া অথবা মাটির নিচের সম্পদ সবকিছুই ভোগ ও উপভোগ করার অধিকার সকলেরই। গায়ের জোরে অথবা ছলে- বলে- কৌশলে তা ছিনিয়ে নেওয়ার জঘন্য মনোবৃত্তি তো আমাদের, মানুষদের! তাই এই গোটা পৃথিবীর সমগ্রটুকুই অতি পবিত্র! আমাদের বাইরের জুতো খুলে রেখে আমরা ঘরে ঢুকি কারণ তা ঘরকে নোংরা করবে! অথচ এই পৃথিবী-মাকে দিনরাত্রি মাড়িয়ে চলেছি ,কখনো মনে হয় সে কথা? কখনো কি মনে মনেও তার কাছে ক্ষমা চাই? পৃথিবীর কাছে অতি গুরুত্বের কোন ধর্মীয় স্থান যেমন পবিত্র তেমনি পবিত্র কোন খোলা মাঠ। রাজপ্রাসাদ যেমন পবিত্র, অতি দরিদ্রের কুঁড়ে ঘরও তাই। পৃথিবীর কাছে দারিদ্র্যের কুঁড়ের পবিত্রতা বোধহয় আরেকটু বেশিই কারণ সূর্যের আলো আর খোলা হাওয়া গরীবের কুঁড়েকে ছুঁয়ে যায়। কিন্তু রাজপ্রাসাদের নিশ্ছিদ্র দেওয়াল আর অহংকারের কঠিন বাধায় আলো, বাতাস সেখানে প্রবেশ করতে ভয় পায়! যদি ভুলভুলাইয়ার গোলকধাঁধায় পথ হারিয়ে ফেলে, আর বেরোতে না পারে! তাই সমগ্র পৃথিবীই পবিত্রতার অপর নাম আর পৃথিবী ও পবিত্রতা পরস্পরের পরিপূরক।