পৃথিবীতে, পৃথিবীর বুকের উপরে, পৃথিবী থেকে যাবতীয় উপাদান সংগ্রহ ক’রে, পৃথিবীর নানা প্রান্তে আমাদেরই অতিপ্রাচীন পূর্বপুরুষরা একের পর এক স্থাপত্য সৃষ্টি করে গেছে। কালের বিচারে, সময়ের বিচারে, উৎকর্ষতার বিচারে কোন কোন স্থাপত্যকে মানুষ প্রাচীন সপ্তম আশ্চর্য বলে উল্লেখ করবে আর কোনগুলিকেই বা নব সপ্তম আশ্চর্য বলে উল্লেখ করবে, তার মানদণ্ড আধুনিক মানুষ নিজেরাই ঠিক করেছে। আমার কাছে এই ‘আধুনিক মানুষ’ বিষয়টাই খুব মজার মনে হয়! এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা যে আধুনিক মানুষ, সর্বার্থেই আমরা আধুনিক, তা কে ঠিক করেছে? আমরা নিজেরাই। অত্যন্ত গুরুত্বহীন কোন পরীক্ষা বা প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রেও আমরা পরীক্ষক রাখি, বিচারক রাখি এবং নানা রকম কড়া নিয়মের বেড়াজালে বাঁধি সেই সব পরীক্ষা ও প্রতিযোগিতাকে। যে মানদণ্ড আমরা ঠিক করে দিই, সেই মানদণ্ডের নিরিখে উত্তীর্ণ হতে না পারলে বা নিয়ম ভঙ্গ করলে অংশগ্রহণকারীকে অকৃতকার্য বলে সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু, নিজেদেরকে আধুনিক বলার ক্ষেত্রে মানুষ নিজেই পরীক্ষার্থী, নিজেই পরীক্ষক। অথচ মানুষ প্রকৃতই সুসভ্য, আধুনিক প্রাণীতে পরিণত হয়েছে কিনা- তার একমাত্র সাক্ষী তো এই পৃথিবী। যে হিংস্রতা, যে বর্বরতা নিয়ে প্রাচীন যুগের মানুষ পরস্পরের উপর প্রবল আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়তো, ধ্বংস করতো, কেড়ে নিত সম্পত্তি, নিষ্ঠুর নির্যাতন চালাত নারীদের উপর, নিজেদের মঙ্গল কামনায় তাদের উপাস্য দেবতার কাছে যথেচ্ছ পশু বলি দিত। এইসবের সত্যিই কোন বদল ঘটেছে? রূপান্তর বা বদল যদি কিছু ঘটে থাকে তা ঘটেছে শুধু উপরের চকচকে মোড়কে, পাল্টেছে শুধু প্রকাশ ভঙ্গিমা! আমরা কেউ কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব, পাঁচ হাজার বা দশহাজার বছর আগে যা ঘটতো, তা আজ আর ঘটে না? গ্যাসচেম্বারের নিধনলীলা, হিরোশিমা-নাগাসাকির পরমাণু বোমা বর্ষণ, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম বয়ে নিয়ে গেছে মৃত্যু-অভিশাপকে, মেয়েদেরকে সমাজ জীবনের অধিকাংশ স্তরে শুধুমাত্র ভোগ্যপণ্য হিসেবে গণ্য করা কিংবা ধর্মের অজুহাতে, দেবতার সন্তুষ্টির নাম করে বা খাদ্য-লালসায় নির্বিচারে অসংখ্য নিরীহ পশু হত্যা। প্রিয় পাঠক, আপনাদের মনে হচ্ছে না, মানুষের ভাষা বদলেছে, পোশাক বদলেছে, স্থান, কাল বদলেছে, পটভূমিও বদলেছে- কিন্তু স্বভাবে মানুষ একই রয়ে গেছে! একটা অত্যন্ত জনপ্রিয় বাংলা গান আছে-
মানুষ ছিল বনমানুষের রূপে
ইতিহাসেই বলে
আদলটা তার বদলে গেছে
দিনবদলের ফলে
সেই মানুষের তৈরি মানদন্ডের বিচারে নয়, ভালোবাসার বিচারে। এইবারে, আমি আলোচনায় নিয়ে আসব আর এক অতি বিখ্যাত প্রাচীন স্থাপত্যের ও নবতম সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম সৃষ্টি- দ্য গ্রেট ওয়াল অফ চায়না বা চীনের মহাপ্রাচীর। এই মহাপ্রাচীর যুগ যুগ ধরে বিস্মিত করেছে বিশ্ববাসীকে। চীনা ভাষায় একে বলা হয় ছাং ছং। একুশ হাজার একশো ছিয়ানব্বই কিলোমিটার দীর্ঘ এই মহাপ্রাচীর খ্রীস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে মিং সম্রাটদের রাজত্বকালে তৈরি হয়েছিল। দুই হাজারেরও বেশী সময় ধরে এই মহাপ্রাচীর তৈরি ও সম্প্রসারিত হয়েছে। এই মহাপ্রাচীর মূলত তৈরি হয়েছিল মাটি, পাথর, ইট, চুন ও কাঠ দ্বারা। যে যে অঞ্চল দিয়ে এই মহাপ্রাচীরটি নির্মাণ করা হয়েছিল, সেই সেই অঞ্চলের স্থানীয় উপাদান প্রাপ্তির উপরেই নির্ভর করেছিল এই প্রাচীর তৈরীর উপাদান। মূলতঃ বাইরের শত্রুর আক্রমণ ঠেকাতে এই মহাপ্রাচীর তৈরি করা হলেও চীন দেশের তৎকালীন অর্থনৈতিক অগ্রগতির পিছনে ও বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের ক্ষেত্রেও এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল চীনের মহাপ্রাচীর।
একটি অত্যন্ত প্রচলিত ও জনপ্রিয় ধারণা আছে যে মানুষের তৈরি পৃথিবীর এটিই একমাত্র স্থাপত্য যা চাঁদ বা মহাকাশের অন্যান্য জায়গা থেকে দেখা যায়। কিন্তু এই ধারণার সঠিক কোন ভিত্তিভূমি নেই। মানুষের প্রবল অধ্যাবসায়, শ্রম ও আত্মবলিদানের প্রতীক হয়ে আছে চীনের এই মহাপ্রাচীর। শোনা যায়, দীর্ঘতম এই প্রাচীর নির্মাণের সময় প্রায় চার লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিলেন এবং তাদের বেশিরভাগকেই সমাধিস্থ করা হয়েছিল এই মহাপ্রাচীরের অভ্যন্তরেই।
এইরকম একটি জনশ্রুতি যখন প্রথম আমার কানে আসে তখন আমি বিভিন্ন মাধ্যম থেকে এর সত্যতা যাচাই করার চেষ্টা করি। ধীরে ধীরে আমি জানতে পারি, মূলতঃ সৈন্যদল ও দন্ডপ্রাপ্ত বন্দীদের দিয়েই তৈরি করানো শুরু হয়েছিল এই মহাপ্রাচীর। এই জনশ্রুতি যদি আংশিক সত্যিও হয়, তবুও এই প্রাচীর এর সাথেই মিশে গেছে অনেক মানুষের শেষ নিঃশ্বাস, অস্থি-মজ্জা, শরীর! তাহলে তো অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে মানুষের শরীরও হয়ে উঠেছিল এই প্রাচীর নির্মাণের অন্যতম উপাদান!
আর কী আশ্চর্য এই পৃথিবী মায়ের দরদ আর সূক্ষ্ম বিচার! যত ভাবছি, ততই আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। আবেগমথিত হয়ে উঠছে আমার শরীর ও মন। যে রাজবংশ শুরু করেছিল এই মহাপ্রাচীর নির্মাণ, যারা এগিয়ে নিয়ে গেছিল এই কাজকে, আর যে রাজবংশের রাজত্বকালে শেষ হয়েছিল এই মহা কর্মযজ্ঞ-কালের অমোঘ নিয়মে তাদের সমস্ত চিহ্ন মুছে গিয়েছে পৃথিবী থেকে কিন্তু এই মহাপ্রাচীরের কিছু অংশ আজও বিদ্যমান। পৃথিবীর অপার মহিমা এখানেই প্রমাণিত। এই মহাপ্রাচীর দর্শন করে মহাবিস্ময়ে আলোড়িত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোন মানুষ যদি কয়েক মুহূর্ত চোখ বুজে সেই হতভাগ্য মানুষগুলোর কথা ভাবে, কান পাতে প্রাচীরের গায়ে, হয়তো শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে সেই মানুষগুলোর হাহাকার কানে এসে পৌঁছবে তাদের। তখনই সার্থক হয়ে উঠবে এই মহাপ্রাচীর দর্শন আর এই মহৎ সৃষ্টি অর্জন করবে মহত্তম অভিধা।
নতুন সপ্তম আশ্চর্যের একটি পেট্রা। এই পেট্রা একটি প্রাচীন শহর। বর্তমান জর্ডনে অবস্থিত এই শহরটি খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে তৈরি হয়েছিল। ঐতিহাসিক ও পুরাতত্ত্ববিদদের কাছে এই প্রাচীন অঞ্চলের গুরুত্ব অপরিসীম। পেট্রাকে ‘গোলাপের শহর’ ও বলা হয়ে থাকে কারণ এই শহরের স্থাপত্যগুলিতে যে রঙের পাথর ব্যবহার করা হয়েছিল, তাদের অনুসারী এই নামকরণ। তৎকালীন সময়ে বাণিজ্যিক দিক থেকে এই শহরটির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। উনিশশো পঁচাশি(১৯৮৫) সালে পেট্রাকে ‘ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ এর মর্যাদায় ভূষিত করা হয়।
এই প্রসঙ্গে আমার মনে হয়, এই যে পৃথিবী তার সমস্ত প্রাকৃতিক উপাদান মানুষের হাতে তুলে দিয়েছে অকৃপণভাবে, যুগ যুগ ধরে তার স্থাপত্যকর্মকে অতি যত্নে রক্ষা করেছে, পৃথিবীর অপরিসীম যত্নেই আমরা দেখতে পেয়েছি এইসব আশ্চর্য স্থাপত্য কর্মকে, সেইসব অনুভূতি যে মুগ্ধতার জন্ম দেয়, তা এই পৃথিবীর জন্যেই।
এরপর যে অনবদ্য সৃষ্টির কথায় আসবো সেটি হল ক্রাইস্ট দি রেডিমির। ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনেরিওতে, করকোভাডো পাহাড়ের চূড়ায় এটি অবস্থিত। ফরাসি ভাস্কর পল ল্যান্ডোস্কি এটি তৈরি করেন উনিশশো বাইশ থেকে উনিশশো একত্রিশ সালের মধ্যবর্তী সময়ে। এটি স্থাপন করেন ব্রাজিলের ইঞ্জিনিয়ার হেইটর ডি সিলভা। যে বেদির উপরে মূর্তিটি দাঁড়িয়ে আছে, সেই বেদির উচ্চতা হলো ছাব্বিশ ফুট আর মূর্তিটির উচ্চতা হল আটানব্বই ফুট। মূর্তিটির দুটো সুদীর্ঘ প্রসারিত হাতের মধ্যে ব্যবধান বিরানব্বই ফুট। খ্রীস্টধর্মের প্রতীক হিসাবে সারাবিশ্বে এটি সমাদৃত। দুই হাজার সাত সালে এই মূর্তিটিকে বিশ্বের নব সপ্তম আশ্চর্যের এক আশ্চর্য বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
মাচ্চু পিচ্চু। এই সপ্তম আশ্চর্যের এক আশ্চর্যের সাথে জড়িয়ে আছে ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। ল্যাটিন আমেরিকার পেরুতে সুপ্রাচীন ইন্কা সভ্যতার নিদর্শন এই মাচ্চু পিচ্চু। সাত হাজার নশো সত্তর ফুট উঁচু পাহাড়ের উপর তৈরি হয়েছিল এই প্রাসাদ। পনেরশো শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত এই মাচ্চু পিচ্চুর অস্তিত্ব বজায় ছিল। পনেরোশো বত্রিশ খ্রীস্টাব্দে স্প্যানিশদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পরেও স্প্যানিশরা কিন্তু এই স্থাপত্যটি খুঁজে পায়নি! উনিশশো এগারো সালে এই ইন্কান সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়। এই স্থাপত্যকর্মের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য হলো প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যথাসম্ভব অক্ষুন্ন রেখে এই স্থাপত্যকর্মটি সম্পন্ন করে ইন্কানরা। ইউনেস্কো উনিশশো তিরাশি সালে মাচ্চু পিচ্চুকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং দুই হাজার সাত সালে (২০০৭) মাচ্চু পিচ্চুকে নব সপ্তমাশ্চর্যের এক আশ্চর্য হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়।
রোম সাম্রাজ্যের একেবারে প্রথম দিকে তৈরি হয় অ্যাম্পিথিয়েটার। এই অ্যাম্পিথিয়েটার হলো প্রচুর দর্শক আসন বিশিষ্ট এক বিশাল স্টেডিয়াম। একেই বলা হতো কলোসিয়াম। রোম সম্রাটদের উদ্ভাবনী শক্তি ও স্থাপত্যবিদ্যার এক আশ্চর্য নিদর্শন। রোম সম্রাটদের জন্যে নানারকম বিনোদন ও প্রকাশ্যে নানা উৎসব অনুষ্ঠানের জন্যেই মাথার উপর উন্মুক্ত আকাশের তলায় ডিম্বাকৃতির বা গোলাকৃতির, ধাপে ধাপে দর্শকাসন বিশিষ্ট এই সুবিশাল স্টেডিয়াম তৈরি। চারপাশ জুড়ে থাকতো দর্শকাসন আর মাঝখানের খোলা জায়গায় চলত নানা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা- যার মধ্যে ছিল গ্ল্যাডিয়েটরদের লড়াই, পশু-মানুষের লড়াই ইত্যাদি। ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে এই অনন্য স্থাপত্য কীর্তির অধিকাংশই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই কলোসিয়ামের সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়। দুই হাজার ষোলো সাল থেকে একটানা তিন বছর মেরামত ও সংরক্ষণের কাজ শুরু হওয়ার পর, কলোসিয়ামের বাইরের কিছু অংশকে সংরক্ষিত করা সম্ভব হয়।
এই কলোসিয়ামের কথা আলোচনা করতে গিয়ে বারবার একটা কথাই মনে হয়, এক অপূর্ব স্থাপত্য কীর্তি হিসেবে এই কলোসিয়াম যেমন আমাদের কাছে পরম বিস্ময় ও মর্যাদার বিষয় হয়ে উঠেছে ঠিক তেমনি ভাবেই নানারকম বীভৎস ক্রীড়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো এখানে, সেগুলো অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও কষ্টের। গ্লাডিয়েটর অর্থাৎ রূপবান, স্বাস্থ্যবান ও শক্তিশালী যুবকদের মরণপণ লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করতে হত এই কলোসিয়ামে। সেই লড়াই ততক্ষণই, যতক্ষণ না একজনের হাতে আর একজনের মৃত্যু নিশ্চিত হতো।
হিংস্র পশু ও মানুষের লড়াইও ছিল অত্যন্ত উপভোগ্য এক আমোদ। যদি কেউ অপরাধ করতো, তাহলে সর্বসমক্ষে এখানেই তাকে নিষ্ঠুর ভাবে শাস্তি দেওয়া হতো। সেই কারণেই আমার মনে হয়, এই এতো নিষ্ঠুরতা এতো রক্তপাত, এতো হিংসা কি সত্যিই পৃথিবী ক্ষমা করে? মনে হয় না। তাইতো প্রবল অহংকারের প্রতীক এই সমস্ত স্থাপত্য, হয় তীব্র ভূমিকম্পে অথবা ভয়ঙ্কর জলোচ্ছ্বাসে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। যেটুকু অংশ আজও পৃথিবীর করুণায় অবশিষ্ট আছে, সেই ভগ্নাংশ আজ যেন এই কোথায় আমাদের মনে করায়- পৃথিবী আমাদের সুযোগ দেয়, উপকরণ দেয়, বুক দিয়ে রক্ষা করে আমাদের সৃষ্টি, কিন্তু মানুষের প্রতি মানুষের অত্যাচার, নিষ্ঠুরতা ও রক্তপাত পৃথিবীকে আহত করে, তার বুকেও নিঃশব্দে রক্তক্ষয় হয়। বারবার সে যেন নীরব ইঙ্গিতে আমাদের বলতে থাকে, সৃষ্টির ভিত হোক ভালোবাসার, চারদেওয়াল হোক মাথার আর ছাদ হোক উদারতা ও সহনশীলতার। তাহলে হয়তো পৃথিবী সত্যি সত্যি মানুষের সৃষ্টিকে অমর করে রাখার পবিত্র দায়িত্ব পালন করবে।
নতুন সপ্তমাশ্চর্যের শেষ আশ্চর্যের কথা এবারে আলোচনা করবো। যদিও একেবারে শেষে আলোচনা করার কারণ এই নয় যে এই দ্রষ্টব্য স্থানটির গুরুত্বে সবার থেকে কম; বরং একেবারে শেষে এই বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থাপত্যকীর্তি নিয়ে আলোচনার করার উদ্দেশ্য এই যে, এই বিশেষ দ্রষ্টব্যটি ভারতবর্ষেই অবস্থিত! তাই এই দ্রব্যটি নিয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা করার লোভ সামলাতে পারলাম না! যুগে যুগে দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ এই স্থাপত্যকীর্তি কে চাক্ষুষ করার জন্য ছুটে এসেছে। এই স্থাপত্যকীর্তিকে দর্শন করার জন্য। এই আশ্চর্য স্থাপত্যটি হল তাজমহল। ভারতবর্ষের এক রাজ্য উত্তরপ্রদেশের যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত এই তাজমহল। ষোলশো আটচল্লিশ খ্রীস্টাব্দে শাহজাহান তাজমহল তৈরি করেন তাঁর প্রিয়তমা, মমতাজ মহলের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। ষোলশো বত্রিশ খ্রীস্টাব্দে তৈরি হয় এই অনন্য তাজমহল! একটানা ষোল বছর ধরে প্রধান স্থপতি আহমেদ শাহ লাহোরি ও হাজার হাজার শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরি হয় এই তাজমহল। আগাগোড়া শ্বেতশুভ্র পাথরে তৈরি এই স্মৃতিসৌধ সদর্পে বিশ্ববাসীর কাছে প্রিয়তমা পত্নীর প্রতি শাহজাহানের প্রেমকে ঘোষণা করে চলেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। দিনের বিভিন্ন সময়ে এই তাজমহল বিভিন্ন রূপ ধারণ করে। বিশেষতঃ পূর্ণ জ্যোৎস্নালোকে তাজমহলকে পাথরের তৈরি কোন সৌধ বলে মনে হয় না। মনে হয় অলৌকিক, অপার্থিব কোন মায়াবী রহস্যময়তা। যুগে যুগে শিল্প-সংস্কৃতি-কাব্য-নাটক-গান রচনার পরম প্রেরণা হয়েছে এই তাজমহল। এসবই অত্যন্ত উজ্জ্বল দিক,পরম পাওয়ার দিক, পরিপূর্ণতার দিক। কিন্তু তার আড়ালেই বুক ফাটা কান্নার আওয়াজ, বিশ্বাসঘাতকতার ঘৃণা আর গাঢ় দীর্ঘশ্বাসও লুকিয়ে থাকে! জনশ্রুতি আছে, তাজমহল তৈরির সময় মার্বেল এমনভাবেই অংকের হিসেবে স্থাপন করা হয়েছিল যে সারাদিনে সূর্যের আলো যখন যেমন ভাবে তাজমহলের উপর পড়বে তাজমহলের রূপও তেমনি ভাবে বদলে যাবে। সকাল, দুপুর, বিকেল, রাত্রি- বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপে ধরা দেয় তাজমহল। সত্যিই আশ্চর্য!! অসাধারণ! কিন্তু এই জনশ্রুতির সাথে সাথে আর একটা জনশ্রুতিও কানে এসেছে আমাদের লোকপরম্পরায়। আমরা কমবেশি সবাই সেটা জানি। আর সেই সঙ্গে আর একটা কথাও জানি, যা রটে, তার কিছুটা অন্তত ঘটে! তাই তাজমহল তৈরির কারিগরি মুন্সিয়ানায় যদি সূর্যের আলো তাজমহলের শুভ্র মর্মর শরীরে প্রতিফলিত হয়ে তাকে দিনের বিভিন্ন সময়ে এক শ্বেতবসনা সুন্দরীর বিভিন্ন ভঙ্গিমায় তাকে উদ্ভাসিত করে তোলে, এই জনশ্রুতি যদি সত্যি হয়, তাহলে এই জনশ্রুতিও সত্যি হতে পারে যে তাজমহল তৈরির পর প্রধান কারিগরের আঙ্গুল শাহজাহানের নির্দেশে কেটে দেওয়া হয়, যাতে তাজমহলের সমতুল্য কোন সৃষ্টি আর পৃথিবীর বুকে না থাকে! এ কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে এর থেকে হৃদয়বিদারক ঘটনা আর কিছু হতে পারে কি! একটি মানুষ তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা এই স্মৃতিসৌধকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সৌধ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তিল তিলকরে ব্যয় করেছিলেন। শাহজাহান তাঁর পত্নী প্রেমকে পৃথিবীর বুকে অমর করে রাখার স্বপ্ন দেখেছিলেন। রাজকোষ থেকে অকাতরে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছিলেন, যা তাঁর রাজভান্ডারে জমা হয়েছিল একটার পর একটা দেশের সম্পদ লুণ্ঠন ও প্রজাদের দেওয়া রাজকরের মাধ্যমে! অথচ যে মানুষটি সম্রাট শাহজাহানের স্বপ্নকে সাকার করে তুলেছিলেন, তিনি তার শ্রম ও মেধার চরম উৎকর্ষতাকে নিবেদন করেছিলেন এই সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। শাহজাহানের চাইতে কোন অংশে তিনি কি কম গর্বিত হয়েছিলেন, যেদিন এই সৌধের কাজ শেষ হয়েছিল, চূড়ান্ত রূপ পেয়েছিল এই স্বপ্ন সৌধ ! মানসিকভাবে বা শারীরিকভাবে কি সেই মানুষটির পক্ষে সত্যি সম্ভব ছিল এই পৃথিবীর বুকে তাজমহলের মত কিছু বা আর একটা তাজমহল গড়ে তোলা! রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-
একবিন্দু নয়নের জল
কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল
এ তাজমহল।
যতবার ‘শা-জাহান’ কবিতার এই পংক্তিগুলি আমার মনে আসে ততবার আরো একটা কথা মনে আসে; সেটা হলো কালের অতি সুবৃহৎ পাত্রে তাজমহল যদি একটা শ্বেতপদ্ম হয়ে ফুটে থাকে, তাহলে ঐ একবিন্দু নয়নের জল হল সেই মানুষটির, যে সম্রাট শাহজাহানের প্রেমময় স্বপ্ন সৌধের শরিক হয়েছিল। তাজমহল যদি সত্যি হয়, তাহলে সেই মানুষটির চোখের জলও তেমনই সত্যি; আজও।