কত আশ্চর্য ছড়িয়ে আছে
এ দেশ ও দেশ -
কুড়িয়েছে ভালোবাসা,
মুগ্ধতা, শ্রদ্ধার রেশ
পবিত্র পৃথিবীতে
মন ছোঁয়া পবিত্র জমি
আজকের ভাবনায়
পৃথিবী ও পবিত্রতম ভূমি
পৃথিবী। আমাদের পৃথিবী। গর্বের, ভালোবাসার, আবেগের পৃথিবী! এই পৃথিবী এক আশ্চর্য রহস্যময়ী! তার আঁচলের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে রয়েছে অজস্র বিস্ময় ও রহস্যভরা সৌন্দর্য এই বিশ্বজুড়ে। সেই সৌন্দর্যেরই কিছু তৈরি করেছে মানুষ। এই পৃথিবীর বুক থেকেই সংগ্রহ করেছে, সেই সৌন্দর্য সৃষ্টির উপাদান আর নিজের উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীতে রেখে গেছে কালজয়ী সব সৃষ্টি। পরম যত্নে তার সমস্ত ভালোবাসাটুকু দিয়ে পৃথিবী শয়ে শয়ে, হাজার হাজার বছর ধরে আগলে রেখেছে এই সমস্ত সৃষ্টিকে আর যুগ যুগ ধরে লক্ষ লক্ষ মানুষ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুটে যাচ্ছে এই সৃষ্টির সৌন্দর্য প্রাণভরে উপভোগ করার জন্যে।
এই মহান সৃষ্টি সম্ভারকে অটুট রাখার পবিত্র দায়িত্ব পৃথিবী নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে, কারোর কোন আদেশ বা অনুরোধের অপেক্ষা না রেখেই। এতেই তো প্রমাণিত হয়, এই পৃথিবীই মহত্তম ও সর্বোত্তম। প্রাচীনকালে অনেক সৃষ্টির মধ্যে সাতটি সৃষ্টিকে বেছে নিয়ে প্রাচীন সপ্তম আশ্চর্য নামে অভিহিত করা হয়েছে। এই আশ্চর্যগুলির মধ্যে প্রাচীনতম সৃষ্টি হল ‘দ্যা গ্রেট পিরামিড অফ গিজা’। পৃথিবীর প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম এই গিজার পিরামিড। মিশর বা ইজিপ্টের বর্তমান বৃহত্তর শহর কায়রোতে অবস্থিত এই পিরামিড। পিরামিডের সামনের দিকের অংশের প্রায় পুরোটাই ধ্বংস হয়ে গেলেও, প্রাচীন মিশরের গৌরবগাথার প্রতীক হয়ে আজও পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে আছে।
এই প্রসঙ্গে গিজার পিরামিডের পর যে স্থাপত্যের কথা মনে আসছে তা হল ব্যাবিলনের শূন্যে ভাসমান বাগানগুলি। নব ব্যাবিলনের সর্বোচ্চ সময় রাজত্ব করা সম্রাট দ্বিতীয় নেবুচাডনাজারের স্ত্রী রানী অ্যামিটিস এর জন্য তিনি তৈরি করিয়েছিলেন এই শূন্যে ভাসমান বাগানগুলি। ৬০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে তৈরি হয়েছিল এই বাগানগুলি, মাটি থেকে অনেকটা উঁচুতে স্থাপত্য শিল্পের অতি আশ্চর্য নিদর্শন হিসেবে তৈরি হয়েছিল এবং গুল্ম, লতা ও বৃক্ষের এক আশ্চর্য সংমিশ্রণ ছিল এই বাগানগুলিতে। কাদা,মাটি ও ইট দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল সুবিশাল পাহাড়ের প্রতিরূপ। যুগ যুগ ধরে মানুষকে অবাক করেছে ইউফ্রেটিস নদী থেকে প্রাচীন হস্তচালিত পাম্পের সাহায্যে জল তুলে একটি বিশাল জলাধারে সংরক্ষিত করা এবং সেখান থেকেই গাছে জল দেওয়ার আশ্চর্য নিপুণ ব্যবস্থা।
এই ব্যাবিলনের শূন্যে ভাসমান বাগানের অস্তিত্ব বজায় ছিল বহু যুগ ধরে। আদরের ছোট্ট ছেলে-মেয়ে সমুদ্রের তীরে যখন বালির ঘর-বাড়ি বা মূর্তি বানায়, তখন মা পাশেই বসে এই কীর্তি উপভোগ করে, আর সজাগ দৃষ্টি রাখে পাশ দিয়ে চলতে চলতে কেউ যেন সেই ছোট্ট হাতের বড় সৃষ্টি পা দিয়ে ভেঙে না দিয়ে যায়! তফাৎ শুধু এই, বালির ঘরবাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্যে আদরের সন্তান মাকে হুকুম করে, মায়ের কাছে আবদার করে,কিন্তু পৃথিবী মায়ের কাছে না করতে হয় হুকুম, না করতে হয় আবদার। সৃষ্টির ও ভাবনার যাবতীয় উপকরণ অকৃপণভাবে যুগিয়ে দেওয়ার পরে, এই পৃথিবী- মা তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব তুলে নেয় নিজের কাঁধে। তা নাহলে, পরবর্তী যুগের মানুষ সেই সৃষ্টি দেখতেই বা পেত কি করে আর স্থায়িত্বের কষ্টিপাথরে তার মহত্বের বিচারই বা হতো কিভাবে!
প্রাচীন যুগের তৃতীয় আশ্চর্য স্থাপত্যটি হল দ্য টেম্পল অফ আর্টেমিস। এটি অবস্থিত ছিল বর্তমান এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে, বর্তমানে যা তুর্কি হিসেবে পরিচিত। এই গ্রীক মন্দিরটি ছিল সুবিশাল আকৃতির এবং অন্যান্য গ্রীক মন্দিরের তুলনায় আকৃতিতে বহুগুণ বড়। গ্রীক দেবী আর্টেমিস এর নামে এই মন্দিরটির নামকরণ হয়েছিল। তৎকালীন রোমানদের কাছে ইনি দেবী ডায়না নামেও পরিচিত ছিলেন। মার্বেল পাথরের তৈরি এই সুবিশাল মন্দিরটি তার বিশালত্বের জন্যেই প্রাচীন সপ্তমাশ্চর্যের একটি বলে ধরা হয়েছিল। হিরোস্ট্রাটাস নামে এক ব্যক্তির মারাত্মক হঠকারিতায়, এক বিধ্বংসী অগ্নিকান্ডে ও গথদের আক্রমণে এই মন্দিরটি ধ্বংস হয়ে যায়।
যে উপাদানগুলি পৃথিবীর বুক থেকে সংগ্রহ করে তৈরি হয় অনন্য সৃষ্টি আবার সেই উপাদানের কোন একটিকে ব্যবহার করেই মানুষ ধ্বংস করে বারবার সেই সৃষ্টিকে। প্রাচীন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি মানুষের এই সৃষ্টি ও তার ধ্বংসই এর এক জ্বলন্ত উদাহরণ।
প্রাচীন যুগে মানুষের তৈরি স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের এক অনুপম মেলবন্ধন হল স্ট্যাচু অফ জিউস। জিউসের এই বিশালাকৃতির বসা অবস্থার মূর্তিটি তৈরি হয়েছিল সোনা, ইবান (বিশেষ এক ধরনের কাঠ), ব্রোঞ্জ (তামা, টিন, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি ধাতুর সংমিশ্রণ) ও আইভরি (স্তন্যপায়ী জন্তুর দাঁতের সাদা উপাদান) দিয়ে। একচল্লিশ (৪১) ফুট উচ্চতার সুদীর্ঘ এই মূর্তিটি তৈরি করেছিলেন গ্রীক ভাস্কর ফিডিয়াস, খ্রীস্টপূর্ব চারশো পঁয়ত্রিশ (৪৩৫) সনে। গ্রীসের অলিম্পিয়াতে জিউসের মন্দিরে এই মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যেখানে প্রত্যেক চার বছর অন্তর ‘অলিম্পিক গেমস’ অনুষ্ঠিত হতো। এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে আশ্চর্য মূর্তিটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
দি মোউসেলিয়াম অফ হ্যালিকারন্যাসাস। এটি প্রাচীনতম স্থাপত্য গুলির মধ্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপত্য। তুর্কিয় বদ্রুমে তৈরি হয়েছিল এই স্থাপত্য। ক্যারিয়া অঞ্চলের শাসক ছিলেন মোউসেলিয়াম । তাঁর মৃত্যুর পর অতি উচ্চ ও অত্যন্ত সুন্দর এই সমাধি স্তম্ভটি তৈরি হয়েছিল তার স্মৃতিরক্ষার্থে। প্রাচীন পৃথিবীর এই স্থাপত্যটি এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়, তবে এই স্থাপত্যের কিছু কিছু ভগ্নাংশ আজও লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা আছে।
ষষ্ঠতম প্রাচীন আশ্চর্যটি হল কলোসাস অফ্ রড্স। একটি প্রাচীন গ্রীসের সূর্যদেবতা হেলিয়াস এর মূর্তি। এই মূর্তির উচ্চতা একশো আট (১০৮) ফুট। ২২৬ বি.সি. এর একটি ভয়াবহ ভূমিকম্পে এটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। প্রাচীন গ্রীসের পূজনীয় সূর্যদেবতার এই সুবিশাল মূর্তিটি প্রাচীন পৃথিবীর একটি অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থান হিসেবেই মর্যাদা পেয়ে এসেছে।
প্রাচীন সপ্তম আশ্চর্যের শেষ যে আশ্চর্যটি নিয়ে এখন আলোচনা করবো সেটি হল লাইটহাউস অফ আলেকজান্দ্রিয়া। ফ্যারোস আইল্যান্ডের ধারে আলেকজান্দ্রিয়ার সমুদ্র বন্দরে এই অতি উচ্চ লাইটহাউস নির্মিত হয়েছিল। এই লাইটহাউসের উচ্চতা ছিল প্রায় সাড়ে তিনশো ফুট। টলেমি রাজবংশের রাজত্বকালে টলেমি দ্বিতীয় ফিলাডেলফাসের আমলে নির্মিত হয়েছিল এই প্রাচীনতম লাইট হাউসটি। এর শীর্ষে প্রাচীন গ্রীসের সমুদ্র দেবতা পেজিডনের এক মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল, তাকে সম্মান করার জন্যে। প্রায় দেড় হাজার বছর অব্দি এই লাইটহাউসের অস্তিত্ব ছিল এই পৃথিবীর বুকে। কিন্তু অতি তীব্র ভূমিকম্পে এই লাইটহাউসটি ধ্বংস হয়ে গেছে।