।। চর্তুবিংশ।।

    ...ডাক্তাররা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, এই মুহূর্তে আমাদের পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে আগামী দু-তিন সপ্তাহ আমাদের কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী সারা ভারতবর্ষে কমপ্লিট লকডাউন ঘোষণা করেছেন।’ এক নিঃশ্বাসে খবরটা পড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন মহীধরবাবু। হাতের কাগজ হাতে রয়ে যায়। ভাবতে থাকেন এই মারাত্মক ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে গোটা পৃথিবী জুড়ে। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম-সর্বত্র একই ছবি। নিজের লেখা একটা কবিতার কয়েকটা লাইন মনে পড়ে গেল এই মুহূর্তে-
মৃত্যুর একমুখী পথে
ভাঙাচোরা ক্যারাভান বয়ে
সময়ের দৃঢ় শিরদাঁড়া
ঘুণধরা রোগে গেছে ক্ষয়ে
    ...সত্যি এ যেন এক মৃত্যু মিছিল চলেছে। কবে, কিভাবে শেষ হবে, কেউ জানে না! কবি Rudyard Kipling এর অতি বিখ্যাত একটি কবিতা Ballad of East and West এর কয়েকটি লাইনও মনে পড়ে গেল-
    East is east, and west is west, and never the twain shall meet.
গর্বিত এক পশ্চিমের কবির এই অহংকারী উচ্চারণ কিন্তু আজ অস্ফুট হয়ে গেছে। করোনা নামের ভাইরাস, ভয় আর মৃত্যুর ঐক্যে বেঁধে ফেলেছে পূর্ব ও পশ্চিমকে! এই ভয়ঙ্কর সময় প্রকৃতি যেন নিঃশব্দে  অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছে কি অসহায় মানুষ নামের সর্বশ্রেষ্ঠ জীব আর কি ভয়ঙ্কর মানব সভ্যতার উৎকর্ষতা!
    যে সর্বগ্রাসী ভয় আজ সারা বিশ্বকে মূক করে দিয়েছে, কেড়ে নিয়েছে অতি প্রিয়জনের শেষকৃত্যের অধিকারটুকুও; সেই মহান রোগের বিরুদ্ধে আজ গোটা পৃথিবী যেভাবে একজোটে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করছে, যে অনন্ত মনোযোগে মরণপণ প্রতিরোধ গড়ে তুলছে ও প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য কাজে লাগিয়েছে সমগ্র মেধা, দক্ষতা ও অর্থবল- তার কিছুটা অংশও যদি এই পৃথিবীকে সুস্থ, সুন্দর রাখার, বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ উপযুক্তভাবে ব্যবহার ও সংরক্ষণ এবং ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দূষণ রোধ করার জন্য ব্যয় করত, তাহলে সমগ্র মানবজাতিকে এই করোনা ভাইরাস নামক প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড়াতে হতো না, যার উত্তর এই পৃথিবীর মানুষের কাছে নেই। অন্তত এখনো পর্যন্ত!
    উন্নত মানবসভ্যতা আজ একটি জটিলতম অঙ্কের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এ যেন প্রবল এক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চেষ্টা। এ কথা সত্যি, বিশ্বজুড়ে চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকটি মানুষ আজ ‘দেবদূতের’ ভূমিকা পালন করছেন। ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন’ এই ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন এ করোনা ভাইরাসকে; তবু একটা সময়ের পর তারাও অসহায় কারণ উপযুক্ত প্রতিষেধক যে আজও অনাবিষ্কৃত। অথচ এই বিশ্বপ্রকৃতি নিঃশব্দে তার অস্ত্রভাণ্ডার, তার প্রাকৃতিক সম্পদ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল মানবজাতির জন্য। বড় মধুর অথচ অমোঘ সেই অস্ত্র। সেই সম্পদের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও উপযুক্ত ব্যবহারই পারবে এই বিপদ থেকে  বাঁচাতে। তবে আশার কথা এই, যখনই মানবসভ্যতা ক্রমবিকাশের পথে চরম সংকটে পড়েছে, বিপন্ন হতে বসেছে তার অস্তিত্ব, তখনই বিশ্বপ্রকৃতির মহায়তায় এই পৃথিবীর বুক থেকেই সে খুঁজে পেয়েছে উদ্ধার পাওয়ার চাবিকাঠি আর রক্তাক্ত অথচ দৃঢ় পায়ে পৌঁছে গিয়েছে অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে। আর এবারও ঠিক তাই হবে।
     ভাবতে ভাবতেই এক অদ্ভুত শিহরণ ছড়িয়ে পড়ে মহীধরবাবুর সারা শরীরে আর তাঁর ডায়েরি টেনে নিয়ে লিখতে বসেন-
 সভ্যতা ধ্বংসের চক্রান্তে
মেতেছে এই করোনা পরজীবী
তবু জয়ী হবে মানবসভ্যতা
 দিশা দেখাবে এই পৃথিবী
    এই প্রসঙ্গেই মহীধরবাবুর মনে পড়ে আর এক  সভ্যতার সংকটের দিনের কথা-
    সেটা ছিল ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাস। মানব সভ্যতার ইতিহাসের এক অন্যতম কলঙ্কের মাস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে চিরকাল। এই আগস্ট মাসে দ্বিতীয় যুদ্ধের শেষ দিকে, আমেরিকা, অতি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে। লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটে, বিকলাঙ্গ হয় অজস্র মানুষ, অতি মারাত্মক তেজস্ক্রিয়তা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ক্ষতি করে এই দুই শহরের, একথা তো কমবেশি সবাই জানি; কিন্তু আমার বলার উদ্দেশ্য, ওই হিরোশিমা শহর যখন সম্পূর্ণভাবে একটা ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছু নয়, তখন মীরহাটান প্রকল্পের বিজ্ঞানী ডক্টর জ্যাকবসেনের কথার উপর ভিত্তি করে লোকে চূড়ান্তভাবে বিশ্বাস করে নিয়েছিল যে হিরোশিমা শহরটি একটি প্রকাণ্ড জঞ্জালের স্তূপে পরিণত হয়েছে এবং আগামী সত্তর বছরেও এই শহরে একগুচ্ছ ঘাসও কোথাও জন্মাবে না। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের ভবিষ্যৎবাণীকে ভুল প্রমাণিত করে ঐ বছরেই শরৎকালের ওলিন্ডার ফুল ফোটে আর শতাব্দী প্রাচীন কর্পূর গাছগুলোতেও নতুন শাখা প্রশাখা জন্মানো শুরু করে। এর থেকে প্রমাণিত হয়, চরমতম ধ্বংসের পরেও নতুন সৃষ্টির ক্ষমতা একমাত্র এই পৃথিবীরই আছে। তার সৃষ্টিশীলতার কাছে মানুষের চরম ধ্বংস প্রচেষ্টাও অতি তুচ্ছ। তাই,আমাদের চারপাশের পরিবেশ, প্রকৃতি ও আবহাওয়া কে আমরা চরম দূষিত না করতাম, যদি অন্য দেশের উপর অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মনোভাব আমাদের মনুষ্যত্বহীন না করে তুলতো,তাহলে যে করোনা ভাইরাস আজ সারা পৃথিবী জুড়ে মৃত্যুর ভয়াল রাজ্য বিস্তার করেছে, তা কিছুতেই পারতো না। কারণ এই পৃথিবীর বুকে যা কিছুই জন্মাক না কেন, যখনই তা জন্মায়, সেই মুহুর্তেই তার মৃত্যু পরোয়ানাও তৈরি করে এই পৃথিবীই। করোনা ভাইরাস অতি প্রকট ভাবে দেখিয়ে গেল, পৃথিবীর বুক থেকে সংগ্রহ করা উপাদান দিয়েই কিন্তু মানুষ তৈরি করবে এই কালান্তক রোগের ওষুধ আর সেটা হবে মানুষকে দেওয়া এই শতাব্দীতে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ।