হাতের খবরের কাগজ মুড়ে রেখে টেবিল থেকে জলের গ্লাস তুলে নিতে নিতে আপন মনেই সম্বিতবাবু বলেন, ‘এই একই খবর পড়তে পড়তে এবার কাগজ পড়াটাই বন্ধ করে দিতে হবে।’ ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সম্বিতবাবুর কথা শুনতে পেয়ে মহীধরবাবু বলেন, ‘কেন, খবরের আবার কি দোষ হল ?’
‘আসুন, আর বলবেন না, যখনই কাগজ খুলি তখনই দেখি মারামারি, খুনোখুনির খবর। কাঁহাতক আর এ জিনিস সহ্য করা যায়।’
‘একেবারে ঠিক বলেছেন,’ বললেন মহীধরবাবু, ‘আরও দুঃখের কারণ কি জানেন, শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা পৃথিবীতে এর পেছনে নানা ধর্মের একটা বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। কার ধর্ম সেরা, কার ধর্ম শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পাবে এই নিয়ে চলেছে নিরন্তর প্রতিযোগীতা। কিন্তু ছোট্ট একটা সহজ কথা আমরা ভুলে যাই, এই ধর্মের রেষারেষি করতে গিয়ে পৃথিবীটাই যদি বাসের অযোগ্য হয়ে যায়, যে মাটির উপর দাঁড়িয়ে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদারের লড়াই চলছে, সেই মাটিই যদি না থাকে, তাহলে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইটা হবে কিসের উপর দাঁড়িয়ে ?’
‘একেবারেই ঠিক বলছেন, আপনার কথা শুনতে শুনতে আমিও এখন অনুভব করি, এই যে পৃথিবী, সে সয়ে যাচ্ছে আমাদের সব কিছু। নীরবে নিঃশব্দে মহত্তম কাজ তো সেই করছে। আমরা এই পৃথিবীর সম্পদই আমাদের দখলে নিয়ে অহঙ্কার করে বলি, আমি কত ধনী, কত সম্পত্তির মালিক অথচ প্রকৃত অর্থে এই পৃথিবীর সমস্ত সম্পত্তির মালিক তো একমাত্র পৃথিবী নিজেই। যদি কোনো ভালো কাজ করার জন্যে, মহৎ কাজ করার জন্যে এই পৃথিবীর কোনো মানুষ ‘গার্ড অফ অনার’ পায় তাহলে আমাদের এই সুন্দর পৃথিবী, যা আমাদের শত কোটি জীবের মাতৃভূমি, তার তো বিশ্বের কোথাও না কোথাও প্রতিদিন অন্ততঃ একবার করে ‘গার্ড অফ অনার’ পাওয়া উচিত বলেই আমি অন্ততঃ মনে করি।’ ‘এই তো একেবারে ঠিক কথা বলেছেন আপনি। সত্যিই তো আমাদের এই বিশ্ব মায়ের প্রতিদিন আমাদের কাছ থেকে ‘গার্ড অফ অনার’ পাওয়া উচিত। আর এই বিষয়ে আমার একটা নিজস্ব ভাবনা আছে। বলব?’ উৎসাহিত মহীধরবাবু বলেন, ‘নিশ্চয় বলবেন, তবে আমার চাকরিটা যেন আবার মাঠে ঘাস খেতে না যায়।’ প্রাণখোলা হাসি নিয়ে বলেন সম্বিতবাবু।
সম্বিতবাবুর কথা শুনে মহীধরবাবুও হেসে ফেলেন, ‘না, না আপনার চাকরিটা কোথাও যাবে না। আমার ভাবনাটা এই যে, প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমরা তো কেউ আমাদের বাবা-মা, কেউ ইষ্টদেবতার নাম স্মরণ করি - সেই সঙ্গে আমরা প্রতিদিন ভোরবেলা উঠে আমাদের এই বিশ্বমাকে প্রণাম করে একটু তো বলতে পারি যে তোমার প্রতি আমরা বড় কৃতজ্ঞ! তোমার এই অপার সৌন্দর্য আর এই অসীম সম্পদ আমাদের জন্যেই তুমি উজাড় করে দিয়েছ। তাই তুমি আমাদের বড় ভালবাসার, বড় আপন। এইভাবে যদি কৃতজ্ঞতা জানাতে পারি, যদি যত্ন নিতে পারি এই পৃথিবীর তাহলে এই ভয়ঙ্কর দূষণের যুগেও ৮০/৯০ বছর আমরা সুস্থ নিরোগ হয়ে বাঁচতে পারি এই পৃথিবী মায়ের আশির্বাদে। একমাত্র এই পৃথিবীর প্রতি ভালোবাসাই এনে দিতে পারে স্থায়ী বিশ্ব শান্তি। আর তখনই এটা সম্ভব যদি আমরা নিজের দেশকে ভালবাসি। এই পৃথিবীর এক একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ হলো দেশ। নিজের নিজের সেই দেশকে ভালবাসতে পারলে সেই ভালবাসা অতি বৃহত্তর হয়ে এই পৃথিবীর উপর ন্যস্ত হবে। আমাদের দিক থেকে এই ভালবাসাটুকু থাকলে, বাকি সবকিছু এই পৃথিবীই আমাদের করে দেবে। আমরা বলি আমরা এটা বা ওটা করেছি, প্রকৃতপক্ষে আমরা প্রত্যক্ষভাবে করতে পারি না। যা করি তা এই পৃথিবী থেকে নিয়েই করি। আর একটা কথাও আমাদের মনে রাখা উচিত, সেটা হল, আমাদের এই পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ, খনিজ সম্পদ, জল সম্পদ - কোনোটাই কিন্তু অফুরন্ত নয়। কোটি কোটি বছর ধরে আমরা সেই সমস্ত সম্পদ যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করি। সেই সঙ্গে অপচয় ও সম্পদ ধ্বংসও বিপুল পরিমাণে করে থাকি। বর্তমানের প্রবল জনবিস্ফোরণের চাপও এই বিষয়ে উদ্বেগের কারণ। তাই ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি’ আবিষ্কৃত হয়েছে। আর কী আশ্চর্য দেখুন, কী অসমান্য দূরদৃষ্টি আমাদের সৃষ্টিকর্তার! তিনি জানতেন, তাঁর তৈরি এই পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ অফুরন্ত,সীমাহীন নয়। একটা দিন আসবে যখন প্রবল জনসংখ্যার চাপে প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডারে টান পড়বে। তাই বুদ্ধি নামক যে বস্তুটি তিনি মানুষকে দিয়ে পাঠিয়েছিলেন, সেই বুদ্ধির জোরে মানুষই একদিন এই সমস্যার সমাধান করবে। আর ঠিক তাই হল, মানুষ নিজেই বুঝতে পারল, সারা বিশ্বজুড়ে প্রবল জনসংখ্যার চাপ কিন্তু এমন একটা ভয়ংকর বিপদের বার্তা বয়ে আনছে যে, এই মুহুর্তে এই জনসংখ্যার বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে একেবারে অচিরেই শূন্য হয়ে যাবে প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার। এই ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি’ যথার্থ ভাবে প্রয়োগ করতে পারলে প্রাকৃতিক সম্পদ ও পৃথিবীর জনসংখ্যায় একটা ভারসাম্য বজায় থাকবে বলেই আমি বিশ্বাস করি। এককথায়, আমাদের ভালবাসা, আশা, আকাঙ্খা ও স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে এই পৃথিবীকে ভালো রাখতে হবে।’ কথা শেষ করেন মহীধরবাবু। আর মুগ্ধ সম্বিতবাবু ডানহাতটা বাড়িয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দেন টেবিলের উপর রাখা মহীবাবুর একটা হাতে।