দোকান থেকে ঠোঙায় করে কিছু নিয়ে এলে সেই ঠোঙার ভাঁজ খুলে দেখা মহীধরবাবুর অনেক দিনের অভ্যাস। অনেক সময় ঠোঙার কাগজে মহীবাবু বাংলা, ইংলিশ-এ এমন কিছু লেখা পেয়েছেন, যা থেকে অনেক নতুন নতুন ভাবনা তাঁর মাথায় এসেছে। আজকেও হাতের ঠোঙাটার ভাঁজ খুলতেই দেখতে পেলেন লেখা আছে —
Think positive and positive will happen. তাড়াতাড়ি দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া কাগজটা দু’হাত দিয়ে চেপে চেপে সোজা করলেন মহীধরবাবু, তারপর অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ঐ একলাইন লেখার দিকে। কে লিখেছে জানা নেই, কতদিন আগে লেখা বা কি উদ্দেশ্যেই বা লেখা তাও উদ্ধার করা কোনদিনই সম্ভব নয়, কিন্তু মহীধরবাবুর মনে হল যে লিখেছে, সে মহীধরবাবুর বড় আপনজন। সুবৃহৎ এক ভাবনার বীজ সে পুঁতে দিয়েছে এই লেখার মধ্যে। আবেগে চোখে জল এসে যায় মহীধরবাবুর। সত্যিই তো সদর্থক চিন্তাই তো জন্ম দেয় সদর্থক ভাবনার, কাজের এবং পরিণতির। সদর্থক ভাবনার সদর্থক তরঙ্গ ছড়িয়ে যায় মানুষের শরীরের অভ্যন্তরে এবং মানুষ সুদীর্ঘ জীবন যাপন করতে পারে খুব গুরুতর কোনো কঠিন অসুখ ছাড়াই। শুধু এইটুকুই নয় — সদর্থক ভাবনা মানুষের শরীরে-মনে যে প্রভাব সৃষ্টি করবে, যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে, তাতে প্রভাবিত হবে তার আশপাশের প্রতিটি মানুষও। উদ্বুদ্ধ হবে তাকে দেখে তার পাশের মানুষ এবং
সদর্থক ভাবনাকে সেও তার জীবনে স্বাগত জানাবে।আসলে পৃথিবী হল চূড়ান্ত সদর্থক ভাবনার প্রতিরূপ আর তাই একবার সদর্থক ভাবনাকে নিজের দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য করে তুলতে পারলে বাকি সমস্তটুকু পৃথিবীই করবে। এই কথা ভাবতে ভাবতেই মহীধরবাবু ডায়রী টেনে নিয়ে লেখেন — ‘ভালো ভাবো, ভালো হবে।’
মহীধরবাবুর নদীর চরের ক্লাস ছেলেমেয়েদের কাছে দিন দিন খুব আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। সেদিন ক্লাস টেনের সায়ন্তন ক্লাসে বলে উঠলো, ‘স্যার আমি বাবাকে বলেছি একটা ত্রিপল কিনে দিতে! আমি দেখেছি, আপনি আমাদের এমন ভাবে বসান, রোদ আমাদের পিঠে এসে পড়ে, কিন্তু আপনার মুখে সরাসরি রোদ পড়ে। আপনার খুব কষ্ট হয়। আমরা তাই একটা ত্রিপল টাঙ্গিয়ে নেব, তাহলে আর আপনার কষ্ট হবে না!’ মহীধরবাবু হেসে বলেন,
‘নারে, সূর্যের আলো হলো প্রকৃতির অকৃত্রিম দান, আশীর্বাদ, পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ মানুষ এমন আছে, যাদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত রোদের আলো গায়ে লাগেনা। ভোরের সূর্য দেখে তাদের গলায় গান গুন গুন করে ওঠেনি, পড়ন্ত রোদে মায়াবী আলো তাদের ব্যাকুল, আবেগাপ্লুত করে দেয়নি! তারা বড়ই দুর্ভাগা, তারা এয়ারকন্ডিশনড বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারকন্ডিশনড গাড়িতে চড়ে এয়ারকন্ডিশনড অফিসে গিয়ে আবার এয়ারকন্ডিশনড বাড়িতে ফিরে আসে আর নয়তো এয়ারকন্ডিশনড ক্লাবে যায়। এ জীবনে ঘাম নেই!’ আজও যথারীতি সেভাবেই ক্লাস চলছে নদীর পারে। সায়ন্তনকেই বলেন মহীধরবাবু, ‘আচ্ছা সায়ন্তন, পৃথিবী তো অত্যন্ত সুন্দর, এটা তো এতদিনে আমরা জেনে গেছি; কিন্তু এটা কি জানিস, পৃথিবী অত্যন্ত স্মার্ট?’
‘কি করে স্যার?’ অবাক প্রশ্ন সায়ন্তনের। ‘আরে একটুখানি ভাব; এই পৃথিবী একেবারে বিনামূল্যে ভোগ আর উপভোগ করার জন্য তার সমস্ত সম্পদ আমাদের দিয়ে দেয় কিন্তু যে কোন ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে হয় মাটিতে মিশে যায়, আর তা না হলে নদী সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যায়। অর্থাৎ পৃথিবী তার সম্পদ একেবারে কড়ায়-গণ্ডায় উসুল করে নেয় আর সেই সঙ্গে একটা সতর্কবার্তা দিয়ে যায় আমাদের। সেটা হল- যদি আমরা পৃথিবীর থেকেও স্মার্ট হতে চাই, তাহলে আমাদের অর্জিত সম্পদের কিছু অংশ ব্যয় করে এই পৃথিবীকে সুস্থ, সুন্দর, দূষণমুক্ত রাখার দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের সবাইকেই। তা নাহলে পৃথিবী কয়েক মুহুর্তের মধ্যে রাজা থেকে ফকির বানিয়ে দেবে আমাদের। সে কেড়ে নেওয়ার আগেই আমরা যদি দিই, তাহলে কে বেশি স্মার্ট হলো? পৃথিবী না আমরা?’
‘আমরা স্যার, আমরা, আমরা।’ হাসিমুখে তাকিয়ে থাকেন মহীধরবাবু উজ্জ্বল মুখগুলোর দিকে।