সকালবেলায় তাড়াতাড়িই ওঠা অভ্যেস মহীধরবাবুর, কিন্তু আজ যেন আরও তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছেন। আসলে গতকাল রাতে ভালো করে ঘুমই হয়নি মহীধরবাবুর। স্কুলে দেবাশিস বলে যে ছেলেটি বছর তিনেক হলো বাংলার টিচার হয়ে এসেছে, সে কালকে মহীধরবাবুকে চার লাইনের একটা ছোট কবিতা পড়তে দিয়েছে। এরকম অবশ্য প্রায়ই দেয়, আর মহীধরবাবুও ওর লেখা বেশ পছন্দই করেন! এই ছোট কবিতাটাই মহীধরবাবুর নিদ্রাহীনতার কারণ। নিজের প্রিয় ডায়েরির ভেতর থেকে ভাঁজ করা কাগজটা বের করে পড়েন মহীধরবাবু।
ভালোবাসার বৃত্ত
বৃত্তের চারপাশে ঘুরে
বৃত্তের মাঝে ফিরে আসা
ভালোবাসা বৃত্তের চারপাশ
নাকি বৃত্তই সেই ভালোবাসা।
বাঃ! মনে মনে আরও একবার তারিফ করেন। কতো অনায়াসে কি গভীর কথা লিখেছে! সত্যই ভালোবাসা-প্রেম বিশাল এক বৃত্ত। এই বৃত্তের চারপাশে ঘুরে ফিরে এসে তো প্রেমের কাছেই নতজানু হতে হয়! প্রেম আর ভালোবাসা যে পরস্পরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত আর পরস্পরের পরিপূরক তাই নয়। ভালোবাসা যদি হয় সুগন্ধি অস্ফুট কুঁড়ি তাহলে প্রেম হলো তার সুরভিত পরম নান্দনিক বহিঃপ্রকাশ! ভাবতে ভাবতে মহীধরবাবুর মনে হয়, প্রেম শব্দটা পৃথিবীর মতই পরিব্যপ্ত। মানুষ, সে যেই হোক না কেন, তার প্রেম পৃথিবীর কোনো একজন মানুষের প্রতি, কয়েকজনের প্রতি অথবা হয়ত অনেক মানুষের প্রতি, কিন্তু সর্বপরিব্যপ্ত হতে পারে না। সর্বজনের প্রতি পরিব্যপ্ত প্রেম একমাত্র পৃথিবীর। তার সবটুকু প্রেম, তার অন্তহীন সৌন্দর্য নিয়ে সে এই মানবজাতির সর্বকালের প্রেমিকা। প্রেমিক বা প্রেমিকার পরস্পরের কাছে অনেক রকমের চাওয়া-পাওয়া থাকে, এই পৃথিবীর কিন্তু তা নয়। সে শুধু চায় তার অপরিসীম প্রেমের বদলে মানুষ তাকে শুধু একটু যত্ন করুক, তার যন্ত্রণা বুঝুক। তার কোনো দাবি নেই। এর থেকে পবিত্র, এর থেকে সহনশীল আর প্রগাঢ় প্রেম — পৃথিবীর কোনো মানুষ অন্য কোনো মানুষের কাছে আশা করতে পারে না। এই কথা ভাবতে ভাবতে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন মহীধরবাবু। ভাবেন, আজকালের মধ্যে যদি স্বপন বাউল দেখা করতে আসে, তাহলে এই কথাগুলো ওর সঙ্গে আলোচনা করবেন। বলা যায় না, হয়তো সব শুনে স্বপন হয়তো একটা দারুণ গান বেঁধে ফেললো আর অনেক মানুষকে শুনিয়ে দিলো সেই গান!
বেশ কয়েকদিন পর আজ মহীধরবাবু এসে বসেছেন তাঁর একান্ত প্রিয় নদীর পাড়ে। এখানে এসে বসলেই মহীধরবাবু অনুভব করেন নদী যেন পৃথিবীর হৃদয় আর নদীর অন্তহীন ছোট ছোট ঢেউ পৃথিবীর হৃৎস্পন্দন। নদীর দিকে বিভোর হয়ে তাকিয়ে থেকে একথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ পায়ে কারোর হাতের ছোঁয়া পেয়ে চম্কে ওঠেন মহীধরবাবু। মুখ ঘুরিয়ে দেখেন কখন স্বপন নিঃশব্দে এসে প্রণাম করে দাঁড়িয়েছে আর মিটি মিটি হাসছে। মুহূর্তে চন্মন করে ওঠে মহীধরবাবুর মন। বলেন, “আরে, কোথায় ছিলে তুমি? আমি তোমার কথা খুব ভাবছিলাম!” মহীবাবুর কথায় অভিভূত হয়ে স্বপন বলে, “স্যার, আপনি আমার কথা ভাবছিলেন?” “হ্যাঁ তো। তোমার কথাই ভাবছিলাম।” তাড়াতাড়ি ঘাসের উপর বসে পড়ে স্বপন বলে, “বলেন স্যার!” মহীধরবাবু বলেন, “কয়েকদিন ধরেই এই কথাটা আমি ভাবছি, এই যে মাতৃগর্ভে আমরা জন্মাই, বেড়ে উঠি, আবার একটা নির্দিষ্ট সময়ে এই পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হই, সেই মানুষটি, যে আমাদের সমস্ত কিছু থেকে আড়াল করে নিজের শরীরে আশ্রয় দিয়ে এই পৃথিবীতে আনে, সেই মানুষটাই পৃথিবীতে আমাদের সব থেকে আপন, সব থেকে শ্রদ্ধার আর ভালোবাসার। যে কোনো সন্তানের কাছে তার মা-ই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মা। এই মানুষটা এমনই, নিজে না খেয়ে হাসিমুখে সন্তানকে খাওয়ায়। সন্তানের বিপদ দেখলে নিজের জীবন তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই মায়ের অন্য কোনো প্রত্যাশা থাকে সন্তানের কাছে এটুকু বাদে, সেই সন্তান সুসন্তান হবে আর মাকে দেখাশোনা করবে, তার যত্ন করবে। অতি সামান্য, অতি মহৎ এই প্রত্যাশা। তবু তো প্রত্যাশা!” এই পর্যন্ত বলে মহীধরবাবু দম নেওয়ার জন্যে একটু থামেন। চুপ করে নদীর দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে যান। স্বপনও চুপ করে তাকিয়ে থাকে মহীধরবাবুর দিকে। একটু পরে সাড় ফেরে মহীধরবাবুর। স্বপনের দিকে তাকিয়ে হেসে বলতে থাকেন, “অথচ দ্যাখো এই পৃথিবী মায়ের কিন্তু সেই প্রত্যাশাটুকুও নেই আমাদের কাছে। এই পৃথিবীতে জন্মে, এই পৃথিবীতে বড়ো হয়ে, জীবনধারণের জন্যে সবকিছু এই পৃথিবী থেকেই সংগ্রহ করে, মৃত্যুর পরে এই পৃথিবীতেই ধুলো হয়ে মিশে যাই। অথচ তার কোনো প্রত্যাশাই নেই আমাদের কাছে। ভারি অদ্ভুত না! কে সুসন্তান, কে কুসন্তান, তা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই! তার যাবতীয় সম্পদ সে সবার জন্যেই উজাড় করে দিয়েছে। এইজন্যেই পৃথিবী মায়েরও মা, সবার মা, সর্বোত্তম।
স্কুল ছুটির পর যেখানে এসে রোজ বসেন সম্বিতবাবু, আজও ঠিক সেইখানেই বসে আছেন। সম্বিতবাবুর এই সময়টা এখানে এসে বসার আর একটা বিশেষ আকর্ষণ হলেন মহীধরবাবু। যদিও এই কথাটা কখনোই তিনি মহীধরবাবুকে জানাননি। কারণ সম্বিতবাবু জানেন মহীধরবাবু তাহলে অত্যন্ত লজ্জিত হবেন। এই প্রচারবিমুখ মানুষটি একটু একটু করে কখন যে সম্বিতবাবুকে তাঁর একান্ত গুণমুগ্ধ অনুরাগীতে পরিণত করেছেন, তা সম্বিতবাবু নিজেও জানেন না। এখন তো এমন অবস্থা, প্রতিদিন অন্ততঃ কিছুটা সময় যদি মহীধরবাবুর সাথে পৃথিবী নিয়ে নানা কথা আলোচনা না হয়, তাহলে মনে হয় দিনটা কোন কিছু না করেই কেটে গেল! বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মহীধরবাবুর সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে সম্বিতবাবু দেখেছেন, এই মহীধরবাবু মানুষটি প্রচুর জ্ঞানের অধিকারী কিন্তু তার বহিঃপ্রকাশ নেই আর অত্যন্ত ভদ্র, নরম এই মানুষটি একমাত্র আগ্রহী পৃথিবী নিয়ে নানা কথা বা ভাবনাচিন্তার ব্যাপারে। যেমন কালকেই মহীবাবু ভারি চমৎকার একটা কথা বললেন, যা আজও সারাক্ষণ ভেবে চলেছেন সম্বিতবাবু। মহীবাবু গতকাল কথা প্রসঙ্গে বললেন — একজন মানুষ যখন বেঁচে থাকে তখন তার কোনো অন্যায় বা অপরাধের জন্যে নানারকম নির্যাতন বা শাস্তিভোগ করতে হয়। মানুষ তাকে কথার শূলে বিদ্ধ করে দেয়! আবার এই লোকটিই মারা গেলে মৃতের প্রতি সৌজন্য প্রদর্শন করে সচরাচর মানুষ ‘শান্তিতে থাকুক, শান্তি পাক বা আত্মার শান্তি হোক’ এই ধরনের কথা বলে থাকে যা আসলে অত্যন্ত অসার ও গুরুত্বহীন; কিন্তু বেঁচে থাকার সময় যদি সঠিক কিছু ভালো ভাবনা ও বার্তা তাকে দেওয়া যেতো তাহলে হয়তো সেই মানুষটি পাল্টে যেত। তার মানসিকতা, আচরণ ও কার্যকলাপ সংশোধিত হত, আর কে বলতে পারে হয়তো সেই মানুষটি সমাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় অবদান রেখে যেতে পারতো। এই কথাটা কালকে থেকে ভেবেই চলেছেন সম্বিতবাবু। এই কথাটা আর কেউই এরকম করে বোধহয় কখনো ভাবেননি! আর এইজন্যেই মহীধরবাবুর তুলনা তিনি নিজেই।