হাতে একটা মোটা ফাইল নিয়ে মহীধরবাবুকে তাঁর রুমে ঢুকতে দেখেই বুকের ভেতরটা গুরগুর করে ওঠে সম্বিতবাবুর। ঐ ফাইলে হয়তো এমন কিছু প্রপোসাল আছে, যেগুলোর অনুমতি দিতে গেলে আবার স্কুল পরিচালন সমিতির বিষনজরে পড়তে হবে। এইসব ভাবতে ভাবতেই মহীধরবাবু বলেন, ‘আমার একটা প্রস্তাব আছে আপনার কাছে।’ সম্বিত বাবু বোঝেন তাঁর আশঙ্কাই সত্যি হতে চলেছে, তবু শুকনো গলায় বলেন, ‘কী প্রস্তাব ?’
‘আসছে বছর পৃথিবী ও কলা-বিপ্লব দিবসে আমরা পৃথিবীর জন্মদিন পালন করবো।’
যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসে সম্বিত বাবুর গলা, ‘আপনি যা বললেন, আমি ঠিক সেটাই শুনলাম তো ? ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ’, উৎসাহিত গলায় বললেন মহীধরবাবু, ‘একদম ঠিক শুনেছেন।’ ‘কিভাবে কি করব আর কী ধরনের অনুষ্ঠান হবে, সে সমস্ত ব্যপারটা আমার এই ফাইলে আছে, আপনি একটু চোখ বুলিয়ে রাখুন। আজ তো শনিবার হাফ-ডে, আমি ছুটির পরেই আসছি, এটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।’ ‘না, না,’ উত্তেজিত গলায় বলেন সম্বিত বাবু, ‘পরে নয়, এখুনি বলুন। আমি রবীন বাবুকে বলছি আপনার ক্লাসটা নিতে। আপনি এর আগে এমন কথা বলেছেন যেগুলো ভীষণ অবাক করেছে আমাকে কিন্তু আজ যে প্রস্তাব রাখলেন, তা এই পৃথিবীর কোনো মানুষ ভাবতে পারে - এটা আমার কল্পনারও অতীত।’
হেসে ফেলেন মহীধরবাবু, চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলেন, ‘বেশ তাহলে শুনুন। এই যে পৃথিবীতে প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষের জন্মদিন পালিত হয়, তার মধ্যে অতি বিখ্যাত মানুষও যেমন আছেন, তেমনি আছে অতি সাধারণ মানুষ। তফাৎ শুধু এই যে বিখ্যাত মানুষদের জন্মদিন পালিত হয় সাড়ম্বরে আর সাধারণ মানুষের জন্মদিন পালন করে শুধুমাত্র তার বাড়ির লোকজন। কিন্তু বিখ্যাত বা অখ্যাত মানুষ, যিনি যে কাজই করে থাকুন না কেন, তা করেছেন অথবা করছেন পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদকে কাজে লাগিয়েই অথবা যা যা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন, তা এই পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের রুপান্তর ঘটিয়েই, এই পৃথিবীর মাটির উপর দাঁড়িয়েই। অর্থাৎ কোনো প্রাকৃতিক মৌলিক উপাদানই মানুষের নিজের সৃষ্টি নয় অথবা ভিন গ্রহ থেকে আনা নয়। তাহলে মানুষ যদি তার কাজের জন্য অভিনন্দিত হয়, তাদের জন্মদিন পালন করা হয়, তবে পৃথিবী যে কোটি কোটি বছর ধরে তার যাবতীয় সম্পদ উজাড় করে দিয়েছে, যাতে পৃথিবীর সব প্রাণী ভাল থাকে, সেখানে আমাদের তো উচিত বছরে একটা দিন নির্দিষ্ট করে পৃথিবীর যে যেখানে আছি, আমাদের মত করে পৃথিবীর জন্মদিন পালন করা। শুধুমাত্র অন্তরের কৃতজ্ঞতাটুকু জানানো ছাড়া তো তাকে কিছু দেওয়ার নেই আমাদের। সেই কৃতজ্ঞতাটুকু সম্বল করে আমরা বলে উঠতে পারি-
এই শুভ জন্মদিনে
তুমি ভালো থাকো পৃথিবী মা
আমরা কৃতজ্ঞ তোমার কাছে।
তুমি শুধু খুশি থেকো মা।’
একটু থেমে আবার শুরু করেন মহীধরবাবু, ‘আর কলা-বিপ্লব বলতে আমি যেটা বোঝাতে চেয়েছি সেটা হল আমরা তো অনেক বিপ্লবের কথা শুনেছি - ফরাসি বিপ্লব, সবুজ বিপ্লব, শ্বেত বিপ্লব, শিল্প বিপ্লব। আমাদের এই কলা বিপ্লব হল এই দিন আমরা মাথা নিচু করে, সানন্দে মেনে নেব যে, এই বিশ্ব প্রকৃতির সর্বশ্রেষ্ঠ কলাবিদ হলেন আমাদের সৃষ্টিকর্তা। একটা ছোট্ট ফুলের পাপড়িতে, একটা পাখির শরীরে অথবা ঐ আকাশের রামধনুতে যে রঙ তিনি ঢেলে দিয়েছেন, যে সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছেন,তার একাংশ সৌন্দর্য সৃষ্টিও সম্ভব নয় কোনো মানুষের পক্ষে! তা তিনি যত বড়ই শিল্পীই হোন না কেন। তাই সেই দিন আমরা সেই মহত্তম সৃষ্টিকে ও সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করব আমাদের সৃষ্ট কলাবিদ্যা অর্থাৎ নাচ, গান, কবিতা পাঠ - ইত্যাদির মাধ্যমে। এই ফাইলে সেই প্রস্তাবই রেখেছি আমি।’
সম্বিতবাবু একটু চুপ থেকে বলেন; ‘আপনার কথা যেদিন মানুষ সঠিক ভাবে উপলব্ধি করবে, সেদিন দেশে দেশে এত যুদ্ধ, এত হানাহানি ঘটবে না।’
‘ঠিকই বলেছেন, যখন দুটো দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধে, তখন না পৃথিবীর, না সেই দেশের কোন ক্ষতি হয়। একটা দেশ যদি ধ্বংস হয়েও যায় তাহলেও ইতিহাসের পাতায় রয়ে যায় সেই দেশের নাম, পৃথিবীও থাকে তার মতোই, শুধু ক্ষতি হয় মানুষের। ভিটেমাটি ছাড়া হয়ে, আত্মীয় পরিজনকে হারিয়ে উন্মাদের মত ছুটে বেড়ায় এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। এক দেশ থেকে আর এক দেশে। সবাই মুখ ফিরিয়ে নেয় এই অবস্থায় কিন্তু মুখ ফিরিয়ে নেয় না আমাদের সেই ধরিত্রী মা, যার ধূলিকণারও যোগ্য নই আমরা, মানুষের শরীর যখন ধ্বংস হয়ে যায়, এই মাটিতে ধূলিকণা হয়ে মিশে যায়, তখন কি আলাদা করা যায়, কোন ধূলিকণা রাজার,কোনটা ফকিরের! মহামহিম সম্রাট আলেকজান্ডারের জীবনের শেষ কয়েকটা দিনের কথা এই বিশ্বসংসারের প্রত্যেকটি মানুষের কাছে শিক্ষণীয়। সম্রাট আলেকজান্ডার যখন উপলব্ধি করলেন, তাঁর মৃত্যু আসন্ন, তখন তিনি উপস্থিত লোকজনদের বলেন, ‘আমি তিনটি উপদেশ এই পৃথিবীর মানুষদের জন্য রেখে যেতে চাই যা আমি উপলব্ধি করলাম আসন্ন মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে।’ এই তিনটি উপদেশের প্রথমটি হল, তাঁর শবদেহ শুধুমাত্র চিকিৎসকরাই বহন করবে। কারণ, পৃথিবীর মানুষেরা যাতে বুঝতে পারে যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম চিকিৎসা করেও সাধ্য নেই মৃত্যুমুখ থেকে মানুষকে ফিরিয়ে আনার। দ্বিতীয় উপদেশে তিনি বলেছিলেন, তাঁর সারা জীবনের অর্জিত মহামূল্যবান ধনসম্পদ যেন তাঁর শব যাত্রার পথে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যাতে মানুষ বুঝতে পারে,তাঁর অর্জিত পার্থিব এই ধনসম্পদ তাঁর কোন কাজেই লাগলো না। আর তাঁর তৃতীয় ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশটি হল, তাঁর কফিনবন্দী শবদেহের হাত দুটো যেন কফিনের বাইরেই রাখা থাকে যাতে সবাই বুঝতে পারে যে মহামহিম সম্রাট আলেকজান্ডারও শূন্য হাতেই এই পৃথিবী ত্যাগ করলেন। অতএব ধন-সম্পদের পেছনে সারা জীবন ছুটে বেড়ালেও যোগফল সেই শূন্যই রয়ে যায়। খালি হাতেই পৃথিবী ছেড়ে যায় মানুষ। আমি মনে করি, এই তিনটি উপদেশের সারাংশ এটাই, যে ধনসম্পদ মানুষ তিলতিল করে, কখনও বা অন্যকে বঞ্চিত করে সঞ্চয় করে, নিজের বলে মনে করে, প্রকৃতপক্ষে তা এই পৃথিবী থেকেই উপার্জিত আর তা এই পৃথিবীতেই ছেড়ে চলে যেতে হয়। যা থাকে তা এই পৃথিবীর প্রতি ভালোবাসা আর সেই ভালোবাসা এই পৃথিবী-মা শতগুণে ফিরিয়ে দেন শুধু সেই মানুষকে নয়, তার অনেক পরের প্রজন্মকেও। তাঁর সবটুকু উজাড় করে দেন। আমার মনে হয়, এই তিনটি উপদেশ থেকে যদি এই সারসত্য আমরা আত্মস্থ করতে পারি তবেই এই উপদেশ তিনটির প্রকৃত মূল্যায়ন হবে।
কত দয়া এই ধরিত্রী মায়ের, এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে গেলেও মানুষকে তিনিই আশ্রয় দেন। একই মাটি ,একই আকাশ, একই জল, একই বাতাস সর্বত্র। তবু আমরা সবসময় দম্ভ করে বলি আমরাই সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষ। আমাদের উচিত মানবতার উর্ধ্বে উঠে কাজ করা। কী হাস্যকর যুক্তি বলুন তো। আমরা মানব জাতি তো নিজেরাই নিজেদেরই শ্রেষ্ঠ জীবে পরিণত করিনি, অন্য অজস্র জীবের তুলনায় অনেক উন্নত স্তরের বুদ্ধি দিয়েছেন আমাদের সৃষ্টিকর্তা। সারা পৃথিবীতে এমন কোনো ল্যাবরেটরি আছে কি যেখানে এক কণা গ্রে ম্যাটার তৈরি করে মানুষের মস্তিষ্কে স্থাপন করা যায় ! তাই সৃষ্টিকর্তার জন্যেই মানব জাতি শ্রেষ্ঠ আর মানুষ তার সাধ্যের মধ্যে থেকেই যেটুকু কাজ পারে তা করে। সবকিছুর উর্ধে উঠে প্রতিনিয়ত যে কাজ করে যায় সে এই পৃথিবী। আমাদের কাজ শুধু কতটুকু জানেন? আগে নিজে সভ্য হওয়া, সভ্য বলে নিজেদের প্রমাণ করা। অত্যন্ত কঠিন কাজ। কিন্তু ছোট ছোট কিছু অভ্যাসের দ্বারাই সহজেই এই কাজ আমাদের আয়ত্তে আসতে পারে। ভাবতে অবাক লাগে আর লজ্জাও লাগে যে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির এই চরম উন্নতির যুগে দাঁড়িয়েও সরকারকে সর্বত্র বিজ্ঞাপন দিতে হয়, যত্র তত্র নোংরা ফেলবেন না, উন্মুক্ত স্থানে শৌচকর্ম করবেন না, বাড়ির চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখুন। আমরা দামী দামী মোবাইল ব্যবহার করতে শিখেছি, ইন্টারনেট কানেকসানের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর সাথে কত সহজে সংযোগ স্থাপন করেছি, প্রযুক্তির অতি উন্নত পরিষেবাকে কাজে লাগিয়ে ঘর গৃহস্থালির কাজ থেকে শুরু করে অফিস-ব্যাঙ্ক পরিষেবা সমস্ত অভ্যাসই কত সহজে আয়ত্ত করেছি। এর সাথে ঐ ছোট ছোট অভ্যাসগুলো আয়ত্ত করতে পারলেই পৃথিবীর প্রতি দায়িত্ব, সচেতনতা ও পৃথিবীর যত্ন নেওয়ার প্রথম ধাপে আমরা পা রাখতে পারব।’
এই পর্যন্ত বলে থামেন মহীধরবাবু আর ঠিক সময়েই স্কুল ছুটির ঘন্টা বেজে ওঠে।