অনেকক্ষণ ধরে পুকুরের জলের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন মহীধরবাবু। এদিকে চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে থাকা ছোটো ছোটো ছেলেময়েরা ক্রমশঃ অধৈৰ্য্য হয়ে পড়ছে; কারণ মহী স্যার ওদের বলেছিলেন যে আজ ওদের ক্লাস হবে মাঠের মাঝখানে, গাছের তলায়, পুকুরের ধারে। কিন্তু গল্প করতে করতে একটু আগে মহী স্যার সেই যে চুপ করে গেলেন, সেই থেকে চুপ করে বসেই আছেন। খানিকক্ষণ মুখ চাওয়া চাওয়ি করার পর একসময় ক্লাস নাইনের রজত ডাকে স্যারকে। দু’তিনবার ডাকার পর অন্যমনস্ক মহীধরবাবু ফিরে তাকান ওর দিকে। তারপর কেমন একটা ঘোরলাগা গলায় বলেন, ‘আচ্ছা রজত, বল তো দেখি, আমরা এই পৃথিবীতে কি করে এলাম ?’ এই রকম একটা প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে ছেলেময়েরা যখন তাকিয়ে আছে মহী স্যারের দিকে, তখন ক্লাস ইলেভেনের প্রদীপ হাত তুলে বলে, ‘আমি জানি স্যার, বলব ?’ একটু হেসে মহীধর বলেন, ‘বল।’ প্রদীপ বলে, ‘স্যার আমার ঠাকুমা সব জানে; আমাকে সব বলেছে।’ ওর সহপাঠী রিন্টু অধৈৰ্য্য গলায় বলে, ‘কি বলেছে ঠাকুমা সেটা বল না।’ প্রদীপ শুরু করে, ‘ঠাকুমা বলেছে ঐ যে আকাশ দেখা যাচ্ছে, ওইখানে ভগবানের বাড়ি। আকাশের বিশাল প্রাসাদে ভগবান একা একা থাকত তো, তাই তার খুব মন খারাপ হয়ে থাকত সব সময়; তাই একদিন ভগবান ঠিক করল যে এমন প্রাণী তৈরী করবে যারা ইচ্ছা করলেই হাসবে, কাঁদবে, কথা বলবে; যেই ভাবা সেই কাজ, কিন্তু সেই প্রাণী তৈরী করার পরে ভগবানের খুব চিন্তা হল যে এই মানুষ নামের প্রাণীগুলো তৈরী তো করলাম, কিন্তু ওদের তো বাঘের মত দাঁত, নখ নেই, হাতির মত গায়ের জোর নেই, পাখির মত উড়তেও পারবে না, তাহল এরা বাঁচবে কী করে ? ভগবান ভেবে ভেবে শেষে একটা অস্ত্র দিল মানুষকে, সেটা হল বুদ্ধি!সেই বুদ্ধির জোরেই মানুষ হয়ে গেলো শ্রেষ্ঠ প্রাণী কিন্তু সেই সঙ্গে ভগবান মানুষকে এটাও বলে দিল যে আমি তোমাদের যেখানে পাঠাবো, দেখবে সেই জায়গাটা কত সুন্দর; কত নদী, পাহাড়, ঝর্ণা, জঙ্গল সব আছে। উপর দিকে তাকালেই দেখতে পাবে আমার এই প্রাসাদ। যেখানে পাঠাচ্ছি সেই পৃথিবীর যত সম্পদ আছে সব ভোগ করো কিন্তু যদি দেখি সেইসব সব সম্পদ ধ্বংস করেছ, নষ্ট করেছ, তাহলে কিন্তু আমি তোমাদের কাউকে আর আমার এই প্রাসাদে ফিরিয়ে আনব না। সোজা নরকে পাঠিয়ে দেব।’ এই পর্যন্ত বলে একগাল হাসি নিয়ে স্যারের দিকে তাকায় প্রদীপ। ‘স্যার,বাপন একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করতে লজ্জা পাচ্ছে’ সন্দীপ বলে। ‘সে কিরে, কি এমন কথা যে লজ্জা পাচ্ছিস’ অবাক মহীধর জিজ্ঞাসা করেন। ‘না স্যার, কয়েকদিন আগে একটা সিনেমা দেখলাম, বাহুবলী ২। দেখলাম বাহুবলীকে যখন তার মামা মেরে ফেলছে তখনও সে বলছে- আমার মাকে দেখো। তাহলে মাকে বাহুবলী কত ভালোবাসত সেটাই ভাবছি স্যার’।
‘ঠিক বলেছিস, প্রত্যেক মানুষেরই উচিৎ, মাকে এরকম করেই ভালোবাসা। মা-ই তো সন্তানকে পৃথিবীতে আনে। মায়ের জন্যেই আমরা সবাই এই পৃথিবী মায়ের এত সৌন্দর্য দেখতে পাই। আবার এটাও ভাবো যে, এই পৃথিবীই যদি না থাকতো তাহলে আমাদের মা আমাদের জন্ম দিত কিভাবে। এই পৃথিবী তাঁর বুকে আমাদের সবাইকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে বলেই আমরা সবাই জন্ম নিতে পেরেছি। তাই এই পৃথিবী হল আমাদের প্রত্যেকের মা। এই মা-কেও আমাদের নিজের মতই ভালবাসতে হবে। বলতে হবে-
পৃথিবী মা সবার মা
বাসতে হবে ভালো
তবেই ভালো থাকবো সবাই
পাবো আশার আলো।
মহীধরবাবু এবার প্রদীপকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘এসব কথা তোর ঠাকুমা বলেছেন?’ প্রদীপ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। অবাক মহীধর স্যার আবার জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোর ঠাকুমা লেখাপড়া জানেন?’
প্রদীপ লজ্জা লজ্জা মুখে মাথা নেড়ে বলে, ‘না স্যার ঠাকুমা বাংলায় নাম সই করতেই জানে না।‘ ভীষণ অবাক গলায় মহীধরবাবু বলেন, ‘অথচ তিনি জানেন এই কথা, কিন্তু আমরা যারা অনেক পড়াশোনা করেছি, অনেক জেনে সমাজের বড় বড় মাথা হয়ে বসে আছি, আমি একজন বিরাট কেউ বলে নিজেকে মনে করছি, তারা কিন্তু এ বিষয়ে জানেও না, আর জানলেও গুরুত্ব দেয় না। এই সামান্য প্রাথমিক জ্ঞানটুকুও তাদের নেই যে এই পৃথিবীই যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে কোথায় থাকবে তাদের বড়মানুষী আর কোথায় থাকবে তাদের অহংকার।’ একটু দম নিয়ে ছেলেমেয়েদের মহীধর স্যার বলেন, ‘তোরা কিন্তু এরকম বড় মানুষ হবি না, যাদের প্রাথমিক বা ভালোমন্দের জ্ঞানই নেই। আমি চাই তোরা এই প্রাথমিক জ্ঞানটুকু অর্জন কর আর সেই জ্ঞানটুকু সবার মধ্যে ছড়িয়ে দে। কিরে পারবি না ?’ সব ছেলেমেয়েরা হাত তুলে একসাথে বলে, ‘হ্যাঁ স্যার, পারব স্যার।’ একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে স্যারের মুখে। ঠিক এই সময়ে ক্লাস এইটের মিন্টু বলে, ‘স্যার অনেক দিন ধরে একটা কথা আমার মনে হয় কিন্তু যদি আমার কথা শুনে সবাই হাসে, তাই লজ্জায় কাউকে বলতে পারিনি। এখন বলব ?’ ‘নিশ্চয়ই বলবি, আমাদের সবার মনের ভেতর যা যা কথা লুকিয়ে আছে, সে সব কথা বলব আর শুনবো বলেই তো আমরা আজ এখানে এসেছি। বলে ফেল,বলে ফেল’ মহীধরবাবু বলেন। মিন্টু বলতে শুরু করে, “আচ্ছা স্যার, আমাদের যে থাকার বাড়ি, সে একতলা হোক বা একশতলা, সেগুলোতে পিলার থাকে, যাতে মাথায় হুড়মুড় করে বাড়ি না ভেঙ্গে পড়ে, কিন্তু স্যার এই যে এতবড় আকাশ, সেদিন আপনি ক্লাসে বলছিলেন যে এই আকাশ হল পৃথিবীর ছাদ, সারা পৃথিবীর যেখানেই আমরা যাই না কেন, এই একই আকাশ দেখতে পাব, তাহলে স্যার এই আকাশ কেন পিলারের উপর দাঁড়িয়ে নেই? তাহলে যে কোনোদিন তো এই আকাশ আমাদের মাথার উপর ভেঙ্গে পড়তে পারে স্যার।’ মিন্টুর কথা শুনে হো হো করে হেসে ওঠে ছেলে মেয়েরা।
দু’হাত তুলে তাদের থামান মহীস্যার। মিন্টুর দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলেন, ‘তুই তো বড় অদ্ভুত ছেলে। এতদিন ধরে এই প্রশ্নটা মনের মধ্যে চেপে রেখে দিয়েছিস। আমাকে তো একবার জানাতে পারতিস।’ লজ্জা পেয়ে মুখ নীচু করে থাকে মিন্টু। মহীধরবাবু বলে চলেন, ‘এই যে প্রশ্নটা তোর মাথায় এসেছে, এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, তোরা পারবি, তোরাই পারবি রে। ঐ যে লোকগুলো গম্ভীর মুখ আর বিশাল টাক নিয়ে বড় বড় জায়গায় বিশাল বিশাল পদে বসে আছে, তারা নিজের জমি, নিজের বাড়ি, নিজের গাড়ি, নিজের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স- এক কথায় নিজের স্বার্থ, শুধুমাত্র নিজের স্বার্থের পাঁকেই একেবারে আগাগোড়া ডুবে আছে। নিজেদের রক্তের মধ্যে বয়ে চলেছে যেন তেন প্রকারেণ এই পৃথিবীর সবটুকু সুখসুবিধে ছিনিয়ে নেওয়ার প্রবণতা। আর শুধু তাই নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মনেও ঢুকিয়ে দিয়েছে এই বিষ। প্রথম থেকেই তাদের মনে ঢুকিয়ে দিয়েছে ভয়ংকর অস্বাস্থ্যকর ইঁদুর দৌড়ের নেশা। শুধু পৃথিবী থেকে লুটে নেওয়ার, শুষে নেওয়ার প্রতিযোগীতাই চলছে সারা বিশ্বজুড়ে। সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে গেছে, তাঁর দয়া ভুলে গেছে, একবারও মনে পড়ে না যে পাহাড়, নদী, ঝর্ণা, ফুলে ফলে সুশোভিত এই পৃথিবী, যেখানে সমুদ্রের তলায় আছে অজস্র মূল্যবান সম্পদ, মাটির তলায় রয়েছে বিপুল খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ। কই এই পৃথিবী নামক গ্রহটাকে তো তিনি আরও অন্য গ্রহের মত প্রাণের বিকাশের যোগ্য করে তৈরী করেননি। সারা দিন-রাতের অজস্র ছোটো-বড়ো কাজের মধ্যে একমূহূর্তও কি মনে পড়েনা আমাদের কতটা কৃতজ্ঞ থাকা উচিত সৃষ্টিকর্তার প্রতি। কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব করে আমাদের পাঠানোর জন্যে। এর অফুরন্ত সৌন্দর্য ভোগ ও উপভোগ করার জন্য। তাঁর এই পরম আশীর্বাদ কিন্তু মুহূর্তে ভয়ংকর অভিশাপে পরিণত হচ্ছে শুধুমাত্র আমাদের অপরিসীম লোভ, চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আর প্রাথমিক জ্ঞানের অভাবে। এই তোর মনে যে কথাটা এল, সেই কথাটার মধ্যে কতবড় জ্ঞান আর দর্শনের কথা লুকিয়ে আছে, সেটা আজ তুই না বুঝলেও, আর একটু বড় হলেই বুঝতে পারবি। আমাদের প্রতি আমাদের সৃষ্টিকর্তার দয়া, মায়া, ভালোবাসা কতখানি প্রবল একবার ভেবে দেখ তোরা; সারা পৃথিবীর যেখানেই যাবি সেই একই আকাশ দেখতে পাবি।
এই আকাশই হল আমাদের পৃথিবীর ছাদ। অথচ এই ছাদ তৈরী করতে ইট, বালি, সিমেন্ট, লোহা কিছুরই দরকার পড়েনি। একেবারে মহাশূণ্যে ভাসছে এই ছাদ। প্রায় প্রতিদিনই আমরা খবরের কাগজে পড়ি, টেলিভিশনে দেখি কত বড় বড় বিল্ডিং-এর ছাদ ভেঙ্গে পড়েছে, কত মানুষ মারা গেছে। অথচ আজ পর্যন্ত কেউ কোথাও শুনেছে যে এই পৃথিবীর ছাদ অর্থাৎ আকাশ ভেঙ্গে কেউ চাপা পড়েছে বা মারা গেছে?’ এতক্ষণ একেবারে আবিষ্ট হয়ে মহীস্যারের কথা শুনছিল সবাই। এবারে সমস্বরে চেঁচিয়ে বলে, ‘না স্যার, কেউ কোনদিন শুনিনি।’ মহীস্যার একটু হাসেন, তারপর হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বলেন, তাহলেই ভাব আমাদের সৃষ্টিকর্তা কত বড়ো মহান কারিগর। মহাশূণ্যে ভাসমান এমন ছাদ তিনি তৈরী করেছেন, যা কোটি কোটি বছর ধরে পিলার ছাড়াই রয়েছে, অথচ আমরা কত শক্তপোক্ত, মজবুত পিলার দিয়ে আমাদের বাড়ির ছাদ বানাই, কিন্তু সেই ছাদ কখন যে মাথার উপর ভেঙে পড়বে তা কেউ জানে না, কোনো ইঞ্জিনিয়ার এ বিষয়ে কোনো গ্যারান্টি দিতে পারে না। একবার মন দিয়ে ভাব, দেখবি সৃষ্টিকর্তার প্রতি কি অপরিসীম কৃতজ্ঞতায় আর আনন্দে মনটা ভরে উঠবে! চোখে জল এসে যাবে আর চিৎকার করে সবাইকে ডেকে ডেকে বলতে ইচ্ছে করবে এই কথাগুলো। কি রে, তোদের ইচ্ছে করছে না।’ ‘হ্যাঁ, স্যার, করছে করছে।’ চেঁচিয়ে ওঠে ক্লাস নাইনের শ্রেয়া। মহীস্যার হেসে তাকান শ্রেয়ার দিকে। তারপর বাকি সবার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘এই ইচ্ছেটাই তো তোদের মধ্যে দেখতে চেয়েছিলাম। তোদের মত ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে দিয়েই সৃষ্টিকর্তা তাঁর আদেশ, নির্দেশ, উপদেশ—সব কিছু পাঠান এই পৃথিবীতে। তোরা যে তাঁর বড় প্রিয়। দেখ, ঘরে দেওয়ালে থাকে যে টিকটিকি, যাকে আমরা কতো ঘৃণা করি, দেখলেই তাড়াই, সেই তুচ্ছ টিকটিকিও কিন্তু কতো সহজেই সত্যি-মিথ্যের প্রভেদ বুঝতে পারে, সত্যি কথাকে টিকটিক শব্দ করে সমর্থন করে। তাহলে আমরা, যারা এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব বলে গর্বে ফেটে পড়ছি, তারা এই সত্যটুকু বুঝব না যে সব কাজের আগে, সব জ্ঞানের আগে এই জ্ঞানটুকু আমাদের বড় প্রয়োজন যে, এই পৃথিবীকে ভালো রাখলেই আমরা বাঁচব। কিরে ঠিক তো?’ সবাই একসাথে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘হ্যাঁ স্যার, ঠিক, ঠিক।’