।। তৃতীয়।।

    স্কুল থেকে বেরোতে আজ অনেক দেরি হল মহীধর বাবুর। আসলে ছুটি হয়ে যাওয়ার পরেও হেডস্যার সম্বিতবাবুর অনুরোধে তার রুমে বেশ খানিকক্ষণ বসতে হয়েছিল মহীধরবাবুকে। স্কুলের পরিচালন সমিতি মহীধরবাবুর বিরুদ্ধে যে সমস্ত অভিযোগ করেছে, তার উত্তরে যে চিঠি তৈরী করেছেন সম্বিতবাবু, সেটাই পড়ে শোনাচ্ছিলেন। মাঠের ধার দিয়ে আসার সময় একটা দৃশ্য দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন মহীধরবাবু। দেখলেন মাঠের মাঝখানে প্রচুর শুকনো পাতা,খড় এনে জড়ো করেছে একদল লোক। যদিও এরা সবাই তাঁর গ্রামেরই লোক কিন্তু আপন খেয়ালে থাকা মহীধরবাবুর সাথে এদের কারোরই তেমন যোগাযোগ নেই। আসল কথা হল, একটু অদ্ভুত, খেয়ালি প্রকৃতির এই মানুষটিকে আশেপাশের লোকজনও একটু এড়িয়েই চলে। যদিও তাঁর স্ত্রী ধরিত্রিদেবীর সঙ্গে কিন্তু পাড়া প্রতিবেশীদের বেশ ভালো সম্পর্ক। মহীধরবাবু একটু সময় দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন ব্যাপারটা। একবার তার মনে হল, কাল কি দোলযাত্রা? তাই কি আজ ‘বুড়ির ঘর’ পোড়ানোর প্রস্তুতি চলছে? কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হল না, ব্যাপারটা তা নয়। তাহলে তো আগামীকালের ছুটির নোটিশ আসত ক্লাসে। কই তেমন তো কিছু আসেনি। কৌতুহলী মহীধরবাবু একজন লোককে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন এত পাতা জড়ো করা হয়েছে কেন? লোকটি জানালো যে যেহেতু এখন ধান উঠে গেছে মাঠ থেকে তাই প্রচুর খড় আর বস্তা বস্তা পাতা জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, মাঠ, রাস্তাঘাট পরিষ্কার করার জন্যে। শিউরে উঠলেন মহীধরবাবু। বুঝলেন, কি অপরিসীম অজ্ঞতার শিকার এরা। যুগ যুগ ধরে এদের বাপ-ঠাকুরদা, আর এখন এরা কি ভয়ংকরভাবে দূষিত করে চলেছে এই পৃথিবীকে, সে সম্পর্কে এদের কোনো ধারণাই নেই। ভয়ংকর ক্ষতিকর গ্যাস উৎপন্ন করছে। কখনও কখনও এই পাতা,খড় ইত্যাদি জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার ফলে এই গ্যাস ছড়িয়ে পড়ছে আশেপাশের সমস্ত এলাকায়। ফুসফুসের সংক্রমণে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যে কোনো বয়সের মানুষ। শুধু তাই নয়, এই বিষাক্ত গ্যাস মিশে যাচ্ছে বাতাসে। একসময় যখন প্রকৃতির নিয়মে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছে মাটির ফসলে, চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা সেই বিষাক্ত জলে পুষ্ট খাদ্যশস্য ব্যবহারের ফলে। আমাদের সন্তানদের জন্যে আমাদের এত আকুলতা, অথচ কোন পৃথিবী আমরা
রেখে যাচ্ছি তাদের জন্যে ? আর আদৌ কি এই পৃথিবী আমাদের বসবাসের যোগ্য থাকবে ? নাকি সৃষ্টিকর্তার আমাদের প্রতি চরম রাগ আর ঘৃণা যেদিন সহ্যের অতীত হয়ে যাবে, সেইদিনই উপস্থিত হবে পৃথিবীতে বসবাসের অন্তিম সময় আর নিজের হাতে নিজের বড়ো আদরের এই পৃথিবীকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফিরিয়ে দেবেন সেই তুষার যুগে, যেখানে প্রাণের সব স্পন্দন চাপা পড়ে যাবে হিমশীতল বরফের তলায়। এইসব কথা ভাবতে ভাবতে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে ওঠেন মহীধরবাবু। ঠিক করেন, ওদের বাধা দিতে হবে। বোঝাতে হবে বারবার। সামান্য সাশ্রয়ের জন্য এইভাবে গাছের ডাল, পাতা কেটে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা যাবে না। নির্বিচারে বন-জঙ্গল ধ্বংস করে ফেলার জন্যে অতি প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা ভীষণভাবে কমে যাচ্ছে, অনাবৃষ্টিতে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাংঘাতিকভাবে। আর অন্য দিকে অতি দ্রুত নেমে যাচ্ছে জলের স্তর, চরম পানীয় জলের সংকট দেখা দেবে এর ফলে। অতি দ্রুত মরুভূমিতে পরিণত হবে এই পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চল। এই পৃথিবীকে ভালবেসে, যে সৃষ্টিকর্তা আমাদের এই শ্রেষ্ঠ জন্ম, মানবজন্ম উপহার দিয়েছেন, তাঁর প্রতি অপরিসীম কৃতজ্ঞতা জানিয়ে, তাঁর অতি প্রিয় এই পৃথিবী নামক গ্রহটিকে সঠিক যত্নে ও ভালোবাসায় সুন্দর করে যদি রাখতে পারা যায়, একমাত্র তবেই বাঁচবে মানুষ ও মানব সভ্যতা। এইসব কথা শুধু এদের বোঝালে হবে না, বোঝাতে হবে ছোট ছোট শিশুদের, এই পৃথিবীকে ভালোবাসার, তার উপযুক্ত যত্ন নেওয়ার একেবারে প্রাথমিক শিক্ষা দিতে হবে তাদের। তারা যদি একবার বুঝে নিতে পারে, তাহলে তাদের চারপাশের সবাইকে তারাই বোঝাতে পারবে। এই শিশুদের মনে এখনো ঐসব সভ্যতার, গর্বের অহংকারের বিষ ঢোকেনি। তাদের মনের ক্যানভাসটাতে এখনো একটিও  আঁচড় পড়েনি। একেবারে ধপধপে সাদা, নিষ্কলুষ। এই ক্যানভাসেই আঁকতে হবে বিশ্ব-মায়ের ছবি। এই পৃথিবীর প্রতি ভালোবাসা আর আবেগের রঙে রাঙিয়ে তুলতে হবে তাদের শিশু মনের ক্যানভাসকে। এই সঙ্গে আরও একটা কথা মনে পড়ে গেল মহীধরবাবুর। সেদিন স্কুলে অনিলবাবু গভীর একটা প্রশ্ন করেছিলেন। ধরণীধর উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র ক্লার্ক, এই মানুষটাকে পছন্দই করেন মহীধরবাবু। এতদিন দেখছেন, কিন্তু কখনো চড়া সুরে কারোর সঙ্গে কথা বলতে দেখেননি। কথায় কথায় সেদিন তিনি মহীধরবাবুকে বললেন, ‘স্যার, আপনি তো এই কাজ করছেন, আপনার এই কাজ কি পৃথিবীতে শান্তি ও সাফল্য এনে দেবে ? আপনাকে তো কেউ কেউ পাগলও বলে।’এই বলেই লজ্জায় মুখ নীচু করেন মৃদুভাষী অনিলবাবু। মহীধরবাবু হেসে ফেলেন কথা শুনে। তারপর একটু গম্ভীর হয়ে বলেন, ‘আমায় পাগল বলুক ক্ষতি নেই, কিন্তু আমার কাজকে যেন পাগলামি না বলে। আমার ভাবনা আর কাজ তো খুবই সহজবোধ্য। আমাদের জীবনে যদি এই পৃথিবী মাকে ভালবাসতে পারি তাহলে এই পৃথিবীর অন্য কোন মানুষকে ঘৃণা ও ধ্বংস করার কথা আমরা তো ভাবতেই পারবো না। কারণ আমরা তখন এই পৃথিবীর অপার সৌন্দর্যে মগ্ন হয়ে থাকব। বার বার কৃতজ্ঞতা জানাব সেই সৃষ্টিকর্তাকে, আমাদের এই পৃথিবীতে আসার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাবো নিজেকে সবদিক দিয়ে মানুষ হিসেবে যোগ্যতর ও উন্নততর করে তোলার জন্য। অন্যকে আক্রমণ করার হিংস্র মানসিকতা তখন একেবারেই নষ্ট হয়ে যাবে। তখন অখণ্ড পৃথিবী জুড়ে বিরাজ করবে অখন্ড ভালোবাসা আর শান্তি ও সফলতা হবে এই পৃথিবীর মানুষের করায়ত্ত।
    এইসব কথা ভাবতে ভাবতে মনটা খুশিতে ভরে ওঠে মহীধরবাবুর, দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে এগোন।