মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যেতেই অভ্যেস মত নিজের পাশটা হাতড়াতে থাকেন ধরিত্রী। তারপর অন্ধকারেই উঠে বসে দেখেন, পাশের ঘরে আলো জ্বলছে। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। নিঃশব্দে উঠে এগোন পাশের ঘরের দিকে।
পাশের ঘরের দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন ধরিত্রী। দরজায় লেখা আছে সাধন কক্ষ— আধ ভেজানো দরজা সজোরে খুলে ভেতরে ঢুকলেন ধরিত্রী। তারপর টেবিলের সামনে এসে চড়া গলায় বললেন- আজকের রাতটাও তাহলে জেগেই কাটবে?
দরজার দিকে পেছনে ফিরে টেবিলে ঝুঁকে পড়ে কাজ করেছিলেন মহীধর সেন। পুরু লেন্সের ফাঁক দিয়ে একবার ধরিত্রীর দিকে তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মন দিলেন। প্রবল বিরক্তি নিয়ে ধরিত্রী পাশের টুলে বসে বললেন—আজকের রাতটাও তাহলে জেগে কাটবে! কতদিন চলবে আর এভাবে? আর কতদিন স্কুল কামাই করবে?
শান্ত গলায় বলেন মহীধর, ‘এই হাতের কাজটা শেষ হলেই জয়েন্ করব।’
‘কবে, সেটা কবে?’ ক্ষিপ্ত গলায় জিজ্ঞাসা করেন ধরিত্রী।
‘বললাম তো, কাজটা শেষ হলেই।
‘এইসব ছাইপাঁশ কাজ করে কি হবে?’
তীব্র ব্যঙ্গের স্বরে বলেন ধরিত্রী — কি! না পৃথিবী বাঁচানোর উদ্যোগ। আরে নিজে বাঁচলে তবে তো পৃথিবী বাঁচবে। তুমি কি পৃথিবী বাঁচানোর ডিস্ট্রিবিউটারশিপ নিয়েছ নাকি?
এইবার মহীধর কাজ বন্ধ রেখে মুখোমুখি ঘুরে বসেন ধরিত্রীর। সেই শান্ত গলাতেই বলেন, না, ডিস্ট্রিবিউটারশিপ নিতে চাইনা আমি। পৃথিবীর লক্ষ-লক্ষ, কোটি কোটি মানুষের মধ্যে আমার কাজ আর ভাবনাকে ডিস্ট্রিবিউট করে দিতে চাই।’
‘আচ্ছা ধরিত্রী, তুমি তো বিয়ের আগে ছেলেমেয়েদের পড়াতে, তাই না?’
‘কি বলতে চাইছ ?’
‘বলতে চাইছি, তুমি একজন শিক্ষিত মানুষ, অনেক বই পড়েছ, অনেক বিষয়ে অনেক জ্ঞান তোমার, কিন্তু কোন বিষয়ে আমাদের সবথেকে আগে আর সবথেকে বেশি জানা উচিত, সেটা জান কি ?’
গলায় আগুন ঝরিয়ে ধরিত্রী জানতে চান, ‘কি সেটা ?’
‘সেটা হল, এই পৃথিবীকে জানা, এই পৃথিবীকে ভালবাসা, বুঝতে শেখা, যা কিছু আবহমানকাল থেকে সৃষ্টি হয়েছে, তা সবই হয়েছে এই পৃথিবী থেকে আর মিশেও গেছে এই পৃথিবীতে। একটু আগে তুমি বললে না যে নিজে বাঁচলে তবে তো পৃথিবী বাঁচবে। ভুল, একেবারে ভুল। যদি এই পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি, তার সমস্ত সম্পদ, সৌন্দর্য ও বিশুদ্ধতা অক্ষুন্ন রাখতে পারি —তাহলে শুধু তুমি আমি নই, আমাদের আরও অনেক অনেক পরের প্রজন্মও বাঁচার মত করে বাঁচবে এই পৃথিবীতে। তাই শুধু কোটি-কোটি বছর ধরে আমরা যে শুধু নিয়েই গেছি পৃথিবীর বুক থেকে, এবার সে সব ফেরানোর পালা।’
‘তুমি কি জান, শুধু পাড়া-প্রতিবেশী বা আত্মীয়-স্বজন নয়, এমন কি তোমার স্কুলেও তোমার আড়ালে সবাই তোমাকে পাগলা মহী বলে ডাকে ? তোমার আড়ালে হাসাহাসি করে তোমাকে নিয়ে। বিন্দুমাত্র মান-ইজ্জত নেই তোমার !
এতক্ষণ ধরিত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে কথা শুনছিলেন মহীধর। এবার আচমকা জোরে হেসে ওঠেন; ‘এইভাবে মহীধরকে হাসতে দেখে প্রচণ্ড রেগে ধরিত্রী বলে ওঠেন, ‘এতে হাসির ব্যাপারটা কি ঘটল ?’
নিজেকে সামলে নিয়ে মহীধর বলেন, ‘না, তোমার কথায় আমার হঠাৎ করে কিছুদিন আগের একটা কথা মনে পড়ে গেল। স্কুলেরই একটা কাজে কলকাতায় গিয়ে যে ট্যাক্সিতে উঠেছিলাম সেই ট্যাক্সির ড্রাইভার খুব দুঃখ করে বলেছিল, লোকে আমাদের ট্যাক্সিতে চড়ে কত জরুরী কাজে যায়, আবার গভীর রাতেও কত লোককে আমরা নিরাপদে বাড়িতে পৌঁছে দিই, অথচ আমাদের কোনো মান-ইজ্জত নেই। আমি তাকে বোঝালাম যে তুমি তো শুধু মানুষের এই উপকারটুকু করছ, তাও অর্থের বিনিময়ে। কিন্তু একবার ভেবে দেখতো, এই যে আমাদের পৃথিবী মা, যে কারোর কাছ থেকে একবিন্দু প্রত্যাশা না রেখে শুধু দু’হাত ভরে আমাদের দিয়েই চলেছে, নীরবে আমাদের সব দাবি মিটিয়ে যাচ্ছে — সে কি তার প্রাপ্য সম্মান পায়? দিনে রাতের অজস্র কাজের ফাঁকে একবারও কি তাকে স্মরণ করি, কৃতজ্ঞতা জানাই ! যে আমাদের সবার মা, সে যদি মান-ইজ্জত না পায়, তাহলে আমরা পরস্পরের কাছে তা, কি করে আশা করবো বলো তো ! আশ্চর্য, আমার কথা শুনে সেই ট্যাক্সি ড্রাইভারের আচরণ পাল্টে গেল, জোরে জোরে কথা বলতে লাগল ও অনুভব করলো পৃথিবীকে সম্মান জানানো কতটা জরুরী। অবশ্য সে অল্পশিক্ষিত ট্যাক্সি-ড্রাইভার বলেই হয়ত আমার কথা বুঝেছে। তুমি উচ্চশিক্ষিতা ধরিত্রী, তাই আমার কথার কোন মূল্য তোমার কাছে নাই থাকতে পারে, আর কি বলছিলে, পাগলা মহী ?’
‘এই পৃথিবীতে প্রচলিত, চিরাচরিত ধ্যান-ধারণার বাইরে যারাই পথ হাঁটার চেষ্টা করেছে, মানুষ তাদের কখনো ক্রুশবিদ্ধ করে, পাথর ছুঁড়ে, হেমলক পান করিয়ে মৃত্যু ঘটিয়েছে। সেখানে আমি তো আমি। আচ্ছা ধরিত্রী, তুমি কি তোমার ছাত্র-ছাত্রীদের কখনো একেবারে প্রাথমিক যে জ্ঞানটুকু প্রতিটি মানুষের থাকা উচিত। সেই বিষয়ে কিছু শিখিয়েছ ?’
‘কি বলতে চাইছ তুমি ?’ চড়া গলায় বলেন ধরিত্রী, ‘কি সেটা ?’
‘এই যে তুমি, আমি মানে আমরা জন্মগ্রহণ করেছি, সেটা কিভাবে ? কার নির্দেশে ? আমরা নিজেদের ইচ্ছেতে আসিনি ; এসেছি সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছেতে। আমাদের প্রত্যেককে তিনি পাঠিয়েছেন আর উপহার দিয়েছেন এই বিশাল বিচিত্র পৃথিবী, আমাদের ব্যবহারের জন্যে। একেবারে বিনামূল্যে। ভেবে দেখেছো একথা কখনও ? আর একথা কি কখনো মনে এসেছে একটি বারের জন্যেও যে শুধু নির্বিচারে ভোগ, পৃথিবীর সম্পদ ধ্বংস আর এই পৃথিবীকে দূষিত করার জন্যে সৃষ্টিকর্তা আমাদের এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব করে পাঠাননি ! সেই সঙ্গে এই পৃথিবীকে সুস্থ রাখার, সুন্দর রাখার দায়িত্বও দিয়েছেন। ভাবো ধরিত্রী, ভাবো। এখন থেকেই ভাবা শুরু করে দাও।’
এই বলে আবার নিজের কাজে মন দেন মহীধর। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে একবার তাকিয়ে দরজার দিকে হাঁটা দেন ধরিত্রী।